Monday, 7 November 2022

শুভ রাসপূর্ণিমা


 

সকল কে জানাই শুভ রাসপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা......

 আমরা অনেকেই জানি না রাস শব্দের অর্থ। ঈশ্বরের সাথে আত্মার মহামিলনকেই রাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রস' শব্দ থেকে 'রাস'-এর উৎপত্তি। মূলত কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে 'রাস'-এর ক্ষণ। 'রস' মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। হিন্দুশাস্ত্রে কথিত আছে রাস পূর্ণিমাতেই কৃষ্ণলীলা করেন। তাই রাস পূর্ণিমাতেই পালিত হয় রাস-লীলা। এই দিনটি বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের লীলা করার দিন। 'লীলা' মানে নৃত্য।'রাসলীলা'- যে নৃত্য পরিবেশিত হয় তার নাম 'রাস-নৃত্য' এটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত, যথাক্রমে-- মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস, নিত্যরাস। প্রেমরসের এই পঞ্চলীলায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ মহারাস-এ। এই পর্যায়েই রয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা- অভিসার, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের রা-আলাপ,কৃষ্ণ নর্তন, রাধানর্তন, গোপীদের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান-প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি, গৃহগমণ।

'চিরহরণ'-এর গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃ্ষ্ণের এই লীলা। কথিত আছে গোপীরা নাকি এই দিনটিতে অপেক্ষা করেন কৃষ্ণের ডাকের জন্য। কতক্ষণে তাঁদের প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণ লীলা- জন্য ডাক দেবেন  তা শোনার জন্য নাকি উন্মুখ হয়ে থাকেন গোপীরা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারাণী   গোপীকাগণ কে নিয়ে বৃন্দাবনের রাগমন্ডলে  কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমায়  মহারাস লীলা করেছিলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা, মহাদেব শিব, স্বর্গরাজ ইন্দ্র, সমস্ত দেব-দেবী, গন্ধর্ব, অপ্সরা-কারও পক্ষে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধারাণীর রাসলীলায়  অনুপ্রবেশ সম্ভব ছিল না  ব্রহ্মা ষাট হাজার বছর তপস্যা করেও ভগবদহ্লাদিনী শক্তি ব্রজগোপিকাগণের রাসলীলা দর্শন করতে সক্ষম হননি।এমন কি বৈকুন্ঠের লহ্মীদেবীও শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলায় প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি, তাই তিনি যমুনার অপর পারে কৃষ্ণপাদপদ্ম ধ্যানেই উপবিষ্ট হয়ে থাকলেন মহাদেব শিবও  রাসলীলা দর্শনে গিয়ে বঞ্চিত হয়েছিলেন

যদিও, 'রাস-লীলা' নিয়ে বেশকিছু মত প্রচলিত আছে। এরমধ্যে বহুল জনপ্রিয় দু'টি মত। এই দুই মতেই কেন এই রাস-লীলা তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কথিত আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। এই থেকেই শুরু হয় 'রাস মেলা' আবার অন্য মতালম্বীদের মতে, দুর্গাপুজোর পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে 'লীলা'- মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই এই পূর্ণিমাতে 'রাস-লীলা' পালিত হয়ে আসছে। কৃষ্ণপ্রেমে 'কাম'-কে জাগতিক ভাবনায় ভাবাটা অপরাধ

আমরা আমাদের শাস্ত্র সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, তাই বিভিন্ন  অপপ্রচারকারী দের বক্তব্যে বিশ্বাস করে রাস-লীলাকে বিকৃত রূপে ভাবতে শুরু করেছি। অপপ্রচারকারীরা অনায়াসে রাসলীলাকে বা রাস নৃত্যকে দৈহিক কাম ভাবনায় নৃত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় অনেকাংশে সফল হচ্ছে আমাদের নিজেদের শাস্ত্রের প্রতি উদাসীনতার কারণে।   রাসে দৈহিক কাম বাসনা জাগ্রত হয়,  তা কিন্তু মূলতঃ নয়। এখানে গোপীরা মানে সকল আত্মা যারা তাঁদের  পূণ্যবলে ভগবানের সাথে মিলিত হয়েছেন তাঁরা শ্রীমতি রাধারানী ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সাথে নৃত্যকীর্ত্তনে মেতে উঠেছিলেন।উল্লেখ্যঃ দৈহিক কামনা বাসনার দেবতা কামদেব যখন  রাস মন্ডলে এসে দৈহিক কাম ছড়াতে চেয়েছিল তখন ভগবান তাকে কদম গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন কারণ, পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলনে কোন কামনা বাসনা থাকে না, শুধু থাকে পবিত্র প্রেমভক্তি। রাস-লীলা- ব্যাখ্যায় কৃষ্ণের বংশীবাদনকে 'অনঙ্গ বর্দ্ধনম' বলা হয়েছে। কেউ যদি ভগবানের স্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয় বা তাকে খাওয়াবার জন্য ব্যকুল হয় অথবা ভগবানের কাছ থেকে আনন্দ পেতে বা দিতে চায়, তাহলে তাকে বলে 'অনঙ্গ' এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল 'কাম' কিন্তু গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ককে এতটা সরলীকরণ করে ভাবাটা অপরাধ। বলা হয় গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম  আধ্যাত্মিকরূপে,জাগতিক রূপে  নয়। গোপীরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কৃষ্ণকে প্রেম নিবেদন করেন, এতে কোনও দ্বিধা,দ্বন্দ্ব রাখার অবকাশটুকু নেই । 

তাই আসুন আজ আমরা সকল ভুল-ভ্রান্তি ভুলে রাধাকৃষ্ণ ভাবে মেতে উঠি।

 

দেব-দীপাবলি

 

image curtsy: google image

শিবের নগরীতে আজ পালিত হচ্ছে দেব-দীপাবলি, যদিও নিয়ম অনুযায়ী আগামীকাল দেব-দীপাবলি কিন্তু আগামীকাল চন্দ্র-গ্রহণ থাকার কারনে আজ এই উৎসব পালিত হচ্ছে।

আসুন জেনে নেওয়া যাক কি এই দেব-দীপাবলি?
দীপাবলির ঠিক পনেরো দিন পরই পালিত হয় দেব দীপাবলি। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় দেব দীপাবলি পালিত হয়। কার্তিক পূর্ণিমাতেই হয় এই উৎসব। বিশেষতঃ বারাণসীতে গঙ্গায় আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয় এই উৎসব। সেই উপলক্ষে গোমতী ঘাট জুড়ে, রাতের গঙ্গায় ভাসানো হয় লক্ষ লক্ষ জ্বলন্ত প্রদীপ।মর্ত্যের নয়। এই উৎসব আসলে স্বর্গের দেবতাদের।কথিত আছে স্বর্গ থেকে এইদিন নাকি দেবতারা নেমে আসেন গঙ্গায় স্নান করতে। দেবতাদের দীপাবলির অংশ হয়ে উঠতেই সবাই এদিন গঙ্গা বক্ষে প্রদীপ ভাসিয়ে দিনটি পালন করেন।পূর্ণিমার চাঁদ দেখে নদীতে প্রদীপ ভাসানোই এই উৎসবের রীতি। দেবী গঙ্গা ও অন্যান্য দেবদেবীর উদ্দেশে গঙ্গার প্রায় প্রত্যেকটি ঘাটে জ্বালানো হয় অন্তত কয়েক লক্ষ প্রদীপ। কার্তিক পূর্ণিমায় সকালে উঠে গঙ্গাস্নান করে সন্ধ্যায় প্রদীপ ভাসানোর প্রথা এই দিনে।অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে ভগবান শিবের জয়কেই এই উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয়। ত্রিপুরাসুরকে মেরে জয়ী হয়েছিলেন শিব। তাই এই উৎসবকে ‘ত্রিপুরোৎসব’ ও বলা হয়।
বিশ্বাস অনুসারে যখন ভগবান কার্তিকেয় তারকাসুরকে বধ করেন, তখন তার তিন পুত্র দেবতাদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তারাকাসুরের তিন পুত্র কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর প্রার্থনা করে, তাঁরা ব্রহ্মাকে বলে “হে প্রভু! আপনি আমাদের জন্য মহাশূন্যে তিনটি পুরী তৈরী করুন এবং অশ্বিনী ভরণীর সংযোগ ক্ষণে যখন এই তিনটি পুরী একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সেইসময় কেউ যদি খুব শান্ত অবস্থায় তীরের সাহায্যে আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করে তাহলেই যেন আমাদের মৃত্যু হয়। ব্রহ্মা তিনজনকেই তাঁদের ইচ্ছামত বর প্রদান করেন।এই বর পাওয়ার পর তাঁরা তিন অসুর তাঁদের আসুরিক শক্তি দ্বারা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমস্ত মানুষ ও দেবতাদের অত্যাচার করতে শুরু করে।এদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সকলে মিলে ভগবান শিবের কাছে সাহায্য চাইতে গেলেন এবং শিবকে অসুরদের সমূলে বিনাশের অনুরোধ করতে লাগলেন।সকল দেবতা ও মানুষের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভগবান শিব, রাক্ষস ত্রিপুরাসুর সহ তিন অসুরদেরকে বধ করেন। ত্রিপুরাসুরের নিধনের আনন্দে সমস্ত দেবতারা প্রসন্ন হয়ে শিবের নগরী কাশীতে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেছিলেন। যেদিন এই সব ঘটেছিল সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথি, তারপর থেকে, কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সর্বত্র দেব দীপাবলি নামে একটি জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব পালিত হয়।
আবার অন্য মতানুসারে ত্রিশঙ্কুকে ঋষি বিশ্বামিত্র তাঁর তপস্যার দ্বারা স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়ে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন, ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর দৃঢ়তায় স্বর্গ মর্ত্য থেকে এক পৃথক এক নতুন জগৎ সৃষ্টি শুরু করেন, তাঁর সাধনার বলের দ্বারা তিনি গাছ-পালা, মাটি, উট, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি সৃষ্টি করলেন। এরই মধ্যে রাজর্ষি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের মূর্তি তৈরি করে তাদের মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন এতে স্বর্গের সকল দেবতারা ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে প্রার্থনা করলে মহর্ষি খুশি হয়ে নতুন জগৎ সৃষ্টির সংকল্প ত্যাগ করেন। এরপর সকল দেবতারা প্রসন্ন হয়ে দীপাবলির মতোই ত্রিভুবনে উৎসব পালিত করেন, সেই থেকে এই দিন দেব দীপাবলি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এটিও বিশ্বাস করা হয় যে আষাঢ় শুক্লা একাদশী থেকে, ভগবান বিষ্ণু চার মাসের জন্য যোগ নিদ্রায় যান এবং তারপর তিনি শুধুমাত্র কার্তিক শুক্লা একাদশীতে জেগে ওঠেন এবং এই একাদশীতে তিনি তুলসীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এরপর কার্তিক পূর্ণিমায় সকল দেব-দেবীরা নারায়ণের ঘুম থেকে জেগে ওঠার আনন্দে লক্ষ্মী ও নারায়ণের মহা আরতি করে প্রচুর প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন।স্বর্গ প্রাপ্তির আনন্দে পালিত হয় দীপাবলি।
অন্য একটি বিশ্বাস অনুসারে, এটিও বলা হয় যে, বামনদেবের স্বর্গ প্রাপ্তির আনন্দে, সমস্ত দেবতা একসাথে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা উদযাপন করেছিলেন এবং গঙ্গার তীরে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, তখন থেকেই দেব দীপাবলি উদযাপনের প্রথা। শুরু হল দীপাবলি। কথিত আছে এই দিনে সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণু মৎস্য অবতার ধারণ করেছিলেন। আর এই দিনে দেবী তুলসী মাঁ র আবির্ভাব হয়। এছাড়াও একটি বিশ্বাস আছে যে কার্তিক পূর্ণিমায় কৃষ্ণ আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন।
কথিত আছে এই দিনে কুলদেবতা ও কুলদেবীকে স্মরণ করে তুলসী তলায় অথবা শিব মন্দিরে অথবা অশ্বত্থ গাছের নীচে কিংবা কুবের দেবতার নাম করে, আকাশ, ব্রহ্মান্ড-মন্ডলের সকল দেব দেবীর উদ্দেশ্যে বা আপনার গুরু দেবকে স্মরণ করে প্রদীপ জ্বালালে মনের অন্ধকার দূর হয় ও ঈশ্বরের কৃপা লাভ হয়।
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...