Friday 26 November 2021

প্রসঙ্গঃ- শনিদেব বা শনিশ্চর

প্রসঙ্গঃ-  শনিদেব বা শনিশ্চর
সঙ্কলক
শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

'শনি' নবগ্রহের একটি অন্যতম গ্রহ, শনি গ্রহকে গ্রহরাজ-ও বলা হয়ে থাকে। শনিদেব সনাতন ধর্ম মতে একজন দেবতা। তিনি উগ্র দেবতা বলে কুখ্যাত।শনিদেবের পরিচয় হল, তিনি হলেন সূর্যদেব ও তার পত্নী ছায়াদেবীর (সূর্যদেবের স্ত্রী ও দেব বিশ্বকর্মার কন্যা দেবী সঙ্ঘামিত্রার ছায়া থেকে সৃষ্ট দেবী ছায়া) পুত্র, এজন্য তাকে ছায়াপুত্র-ও বলা হয়। শনিদেব, মৃত্যু ও ন্যায় বিচারের দেবতা যমদেব বা ধর্মরাজ ও পবিত্র শ্রী যমুনা দেবীর ভ্রাতা।
বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে শনির কাহিনি সম্পর্কে ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। মৎস্য পুরাণে বলা হচ্ছে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার মেয়ে সঙ্ঘামিত্রা সঙ্গে বিয়ে হয় সূর্যদেবের। কিন্তু সূর্যের প্রচণ্ড তাপে প্রায় ঝলসে যান সঞ্জনা। তখন তাঁর নতুন নাম হয় সন্ধ্যা। নিজের এমন দূরবস্থায় স্বামীর প্রতি সমস্ত ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সূর্যের থেকে দূরে পালাতে চান তিনি। কিন্তু কী ভাবে? তখন সন্ধ্যা নিজেরই একটি প্রতিকৃতি সৃষ্টি করেন। বলা যেতে পারে এটিই বিশ্বের প্রথম ক্লোন। তাঁর নাম দেন ছায়া। ছায়াকে স্বামীর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে সন্ধ্যা পিতার ঘরে ফিরে যান। এ ভাবে যে তাঁর স্ত্রী বদল হয়ে গেল তা খেয়ালই করেন না সূর্যদেব।
পরবর্তীকালে সূর্য ও ছায়ার সন্তান হিসেবে জন্ম নেন শনি। মেয়ে তাঁর কাছে, এদিকে সূর্যের সন্তান-জন্মের খবর পেয়ে বিশ্বকর্মা ধন্দে পড়ে যান। সন্ধ্যার কাছে ছুটে গিয়ে সব জানতে চান। সব শুনে বিশ্বকর্মা সন্ধ্যাকে সেই মুহূর্তেই পতিগৃহে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। ক্ষুব্ধ সন্ধ্যা ফিরে গিয়ে ছায়াকে নিঃশেষ করে নিজে ফের সূর্যের স্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এ ঘটনাও সূর্যের নজর এড়িয়ে যায়।
এর পর শনির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে শুরু করেন সন্ধ্যা। শনিকে সূর্যের থেকে দূরে সরাতে অনবরত স্বামীর কান ভাঙাতে থাকেন সন্ধ্যা। এভাবে মায়ের স্নেহ এবং বাবার ভালোবাসা না পেয়ে ক্রুদ্ধ, বিরক্ত, অলস হয়ে উঠতে থাকেন শনি। কোনও কিছুই তাঁর ভালো লাগে না।
পরবর্তীকালে সূর্যের ঔরসে সন্ধ্যার গর্ভে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখা হয় যম ও মেয়ের নাম যমুনা। ক্রমে ছেলে-মেয়েরা বড় হলে তাঁদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন সূর্য। যমকে দেওয়া হয় ধর্মরাজের দায়িত্ব। পৃথিবীর বুকে ধর্মরক্ষার দায়িত্ব তাঁর। যমুনা পবিত্র নদীর রূপ নিয়ে সব পাপ-তাপ ধুয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পান।
সন্ধ্যার ক্রমাগত কান ভাঙানোর ফলে বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শনিকে কোনও দায়িত্বই দেন না সূর্য। এ ভাবে বঞ্চিত, অসহায় শনি ভাই-বোনের থেকে দূরে সরে গিয়ে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। একদিন শোক ও রাগে পাগল হয়ে সন্ধ্যাকে লাথি মারেন তিনি। সেই রাগে শনিকে খোঁড়া হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন সন্ধ্যা। মা-কে লাথি মারার জন্য শনির ওপর সূর্য ক্রুদ্ধ হলেও বেশি অবাক হন সন্ধ্যার ভূমিকায়। একজন মা কী করে তাঁর সন্তানকে এমন অভিশাপ দিতে পারেন! সন্ধ্যার কাছে সব কথা জানতে চান তিনি। সূর্যের জেরায় ভেঙে পড়ে অবশেষে তাঁকে সব জানাতে বাধ্য হন সন্ধ্যা। শনির ওপর এতদিন এত অন্যায় হয়েছে বুঝতে পেরে নিজের ভুল স্বীকার করেন সূর্য। শনিকে সৌরমণ্ডলে স্থান দেন তিনি। কর্মফলের দেবতা হিসেবে শনিকে উন্নীত করা হয়। এ জন্যই কেউ কোনও অপকর্ম করলে শনির নজর এড়ায় না এবং শনির হাতে তার শাস্তি নিশ্চিত।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে একদিন শনি দেবের স্ত্রী দেবী ধামিনী সুন্দর বেশভূষা নিয়ে তার কাছে এসে কামতৃপ্তি প্রার্থনার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি সেদিকে খেয়ালই করেন না। যার ফলে অতৃপ্তকাম পত্নী শনিকে অভিশাপ দিলেন, ‘আমার দিকে একবারও তুমি ফিরেও চাইলে না। ঠিক আছে এরপর থেকে তুমি যার দিকে চাইবে, সে-ই ভস্ম হয়ে যাবে’। তবে অনেকের মত ঘটনাটি মঙ্গলদেবের চক্রান্তে হয়েছিল।
আরো একটি কাহিনী
শনি দেবের জন্ম নিয়ে পুরাণে অনেক কিছু বর্ণনা রয়েছে। শোনা যায়, সূর্যদেবের স্ত্রী সঙ্ঘামিত্রা দেবী, তাঁর স্বামীর প্রখরতা ও তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীর থেকে ছায়ার সৃষ্টি করেন। সেই ছায়া তিনি নিজের জায়গায় বসিয়ে রেখে তপস্যায় যান। সেই সময় ছায়ার সঙ্গে সূর্যদেবের মিলনের ফলে শনির জন্ম হয়।কিন্তু তাঁর গায়ের রং হয় কুচকুচে কালো, যা নিয়ে সূর্যদেব দেবী ছায়াকে তাঁর পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। মায়ের এই অপমান সহ্য করতে পারতেন না শনি দেব। একদিন বদলা নিতে অগ্নিদৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকান তিনি। যার ফলস্বরূপ সূর্য পুড়ে কালো হয়ে যান।সেই সময় শিব এসে রক্ষা করেন সূর্যকে। শিবই সূর্যকে সমস্ত সত্যি জানান এবং কোনও অন্যায় দেখলে তার বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে যান শনিকে। সেই থেকেই বিচারের দেবতা হিসাবে পরিচিত শনি দেব।
শনিদেবকে কোনও অপশক্তি মনে করলে ভুল করা হবে। তিনি ইচ্ছা করে কোনসময় কারোকে বিপদে ফেলেন না। গ্রহ হিসেবে শনি নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেন। এই গুণগুলি থেকে বিচ্যুত হলে তিনি কুপিত হন। মানুষের যাবতীয় কর্ম— ভাল-মন্দ কিছুকেই শনিদেব লক্ষ করেন। দুষ্কর্মের জন্য তিনি রুষ্ট হন। কতগুলি সদগুণ শনি যেমন নিয়ন্ত্রণ করেন,তেমনই দুর্ঘটনা, লোভ, নেশা বা আসক্তি, অপরাধ প্রবণতাকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। শনিদেব কিন্তু পরম শিবভক্ত। কারো প্রতি শনি কুপিত হলে তিনি আগে থেকেই তার আভাস পেয়ে যাবেন অন্তত আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার উল্লেখ আছে। আমরা প্রায়ই শুনি শনির দশা চলেছে। একথা অপ্রিয় হলেও সত্যি আমাদের ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণে শনিদেব এক অতি পরিচিত দেবতা উনাকে নিয়ে হাজারো কাহিনীর পরিচয় আমরা পাই। তার মধ্যে একটি অতি জনপ্রিয় কাহিনী হল নল-দময়ন্তীর। শনির প্রকোপে রাজা নলের কী দশা হয়েছিল, তা আমরা সকলেই অবগত।
এবার আপনারা বলুন তো, আপনারা কি ভাবেন, সত্যিই কি শনি এক ভয়ানক দেবতা?

May be an image of sky
Like
Comment

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...