Saturday 17 November 2018

শ্রীশ্রী জগদ্ধাত্রী মা--সঙ্কলক শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী



মা জগদ্ধাত্রীর পূজা কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এর উল্লেখ কাত্যায়নীতন্ত্রতে পাওয়া যায় দুর্গাকল্প বর্নিত এই যে
-দেবগণের হিত, দুর্বত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তিবিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী (জগদ্ধাত্রী) আবির্ভূতা হলেন
কালবিবেক গ্রন্থে পূজার বিধান প্রসঙ্গে শূলপাণি লিখছেন:
কার্তিকোঽমলপক্ষস্য ত্রেতাদৌ নবমেঽহনি

পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে নিষেদূষীম্।।
-ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে সিংহপৃষ্ঠে সমাসীনা দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা করিবে
জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা বলে বিবেচিতসপ্তমী, অষ্টমী নবমী এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে তবে অনেক স্থলে  নবমীর দিনেই তিন বার পূজা করে সপ্তমী, অষ্টমী নবমী পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকেআবার অনেক ক্ষেত্রে প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন হয়ে থাকেদুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জন ও বিজয়াকৃত্য হয়ে থাকেপুষ্পাঞ্জলীর মন্ত্র দক্ষিনা-কালীর মন্ত্রের ন্যায় হলেও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্র দুর্গাপূজার মন্ত্রের ন্যায়

যদিও জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব বলে বিবেচিত তবুও  দুর্গা বা কালীপূজার ন্যায় এই পূজার প্রচলন তেমন নয় তবে আধুনিক কালে এই পূজার প্রচলন বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছেএই পূজার ইতিহাস বিচার করলে দেখা যায় যে আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রথম প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা উত্তরতর বৃদ্ধি পায়  দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি পরিবারের অতি-পরিচিত এক দেবী, এর বিভিন্ন প্রমাণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়া যায়শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়, যা  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত  কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ারশান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয় তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকতো বলে জানা যায়
দেবীর রূপের বর্ণনা তাঁর ধ্যান মন্ত্রে আমরা পাই...... যা হলো......
সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্ 

চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্ 
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
ত্রিবলীবলয়োপেতনাভিনালমৃণালিনীম্
রত্নদ্বীপে মহাদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।।


- অর্থাৎ মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে ভূষিতা নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ শার্ঙ্গধনু; দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র পঞ্চবাণ রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন তাঁর ত্রিবলিবলয়সমন্বিত নাভিমণ্ডল মৃণালবিশিষ্ট পদ্মের ন্যায় সেই শিবপত্নী রত্নদ্বীপরূপ উচ্চ বেদিকায় স্থিত সিংহাসনে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্টা

নাগযজ্ঞোপবীতিনী জগদ্ধাত্রী; নাগরূপ যজ্ঞোপবীত মহাযোগিনী ব্রহ্মময়ী জগদ্ধাত্রীর প্রতীকজগদ্ধাত্রী দেবীর মূর্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “অর্ক বা সূর্যই বিশ্বের পোষণকর্তা পৃথিব্যাদি আবর্তনশীল গ্রহ-উপগ্রহদিগকে সূর্যই নিজের দিকে আকর্ষণ করে রেখেছেন দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যেও ধারণী পোষণী শক্তির পরিচয় বিদ্যমান তাই তাঁকে বলা হয়েছে বালার্কসদৃশীতনু একই কারণে জগৎপালক বিষ্ণুর শঙ্খ-চক্র-শার্ঙ্গধনু-আদি আয়ুধ দেবীর শ্রীকরে... দেবীর রক্তবস্ত্র রক্তবর্ণের মধ্যে, দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে সেই রজোগুণেরই ছড়াছড়ি রজোদীপ্ত বলেই জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিময়ী তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, তাঁর বাহন সকলই তাঁর শক্তিমত্তার ভাবটি আমাদের অন্তরে উদ্দীপ্ত করে দেয় তবে দেবীর এই বীর্য সংহারের নয় পরন্তু সমগ্র বিশ্বকে মহাসর্বনাশ থেকে রক্ষাপূর্বক তাকে আত্মসত্তায় ঋতে সত্যে সুস্থির করে রাখবার জন্য ... নাগ বা সর্প যোগের পরিচায়ক উপবীত ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতীক দেবী জগদ্ধাত্রী ব্রহ্মময়ী; তিনি পরমা যোগিনী মহাযোগবলেই ব্রহ্মময়ী ধরে আছেন এই নিখিল বিশ্বসংসারকে এই জগদ্ধারণই জগদ্ধাত্রীর পরম তপস্যা তাঁর নিত্য লীলা, তাঁর নিত্য খেলা জননীরূপে তিনিই বিশ্বপ্রসূতি, আবার ধাত্রীরূপে তিনিই বিশ্বধাত্রী
জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ খুঁজলে আমরা দেখি যে এই শব্দের অর্থ হলো জগৎ+ধাত্রী অর্থাৎ জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)” ব্যাপ্ত অর্থে দুর্গা, কালী সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রীতবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন স্বামী প্রমেয়ানন্দের মতে,
ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য... ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত... নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তার রক্ষণ পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত যিনি নিত্যা, শাশ্বতী অপরিবর্তনীয়া দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি
কেন উপনিষদে বর্ণিত একটি উপাখ্যান অনুসারে : একবার দেবাসুর সংগ্রামে দেবগণ অসুরদের পরাস্ত করলেন কিন্তু তাঁরা বিস্মৃত হলেন যে নিজ শক্তিতে নয়, বরং ব্রহ্মের বলে বলীয়ান হয়েই তাঁদের এই বিজয় ফলত তাঁরা হয়ে উঠলেন অহংকার-প্রমত্ত তখন ব্রহ্ম যক্ষের বেশ ধারণ করে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন তিনি একটি তৃণখণ্ড দেবতাদের সম্মুখে পরীক্ষার নিমিত্ত রাখলেন অগ্নি  বায়ু তাঁদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেই তৃণখণ্ডটিকে দগ্ধ বা বিধৌত করতে পারলেন না তখন দেবগণ ইন্দ্রকে যক্ষের পরিচয় জানবার নিমিত্ত প্রেরণ করলেন ইন্দ্র অহংকার-প্রমত্ত হয়ে যক্ষের কাছে আসেননি, এসেছিলেন জিজ্ঞাসু হয়ে তাই ব্রহ্মরূপী যক্ষ তাঁর সম্মুখ হতে তিরোহিত হলেন বরং তাঁর সম্মুখের আকাশে দিব্য স্ত্রীমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন হৈমবতী উমা উমা ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে ইন্দ্রের জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত করলেন
কিন্তু  কাত্যায়নী তন্ত্র নামক
উপনিষদে উমার কোন রূপবর্ণনা নেই কেবলমাত্র তাঁকে হৈমবতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা বলা হয়েছে তবে এই হৈমবতী উমাই যে দেবী জগদ্ধাত্রী সে প্রত্যয় জন্মে কাত্যায়ণী তন্ত্রের ৭৬ পটলে (অধ্যায়) উল্লিখিত একটি কাহিনি থেকে এই কাহিনি অনুসারে : একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু  চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন তাঁরা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই মহাশক্তির শক্তিতেই তাঁরা বলীয়ান দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন এর পরের কাহিনি কেন উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন তখন দেবী তাঁর তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন; দেবগণও তাঁর স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন 
সর্বশেষে দেবী জগদ্ধাত্রীকে তাঁর স্তব মন্ত্রে প্রণাম জানিয়ে আমি এই সঙ্কলিত তথ্যটি সমাপ্ত করছি মা আনন্দময়ী সকলকে আনন্দে রাখুন এই প্রার্থনা করি
শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী স্তব...

ওঁ আধারভূতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধরে
ধ্রূবে ধ্রূবপদে ধীরে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে
শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে
জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
পরমাণু স্বরূপে দ্ব্যণুকাদি স্বরূপিণি
স্থূলাতি সূক্ষ্ম রূপেণ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম রূপে প্রাণাপানাদিরূপিণি
ভাবাভাব স্বরূপে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
কালাদি রূপে কালেশে কালাকাল বিভেদিনি
সর্ব্ব স্বরূপে সর্ব্বজ্ঞে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
মহাবিঘ্নে মহোৎসাহে মহামায়ে বলপ্রদে
প্রপঞ্চাসারে সাধ্বীশে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
অগম্যে জগতামাদ্যে মাহেশ্বরি বরাঙ্গনে
অশেষ রূপে রূপস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
দ্বিসপ্তকোটি মন্ত্রাণাং শক্তিরূপে সনাতনি
সর্ব্ব শক্তি স্বরূপে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
তীর্থযজ্ঞ তপোদান যোগসারে জগন্ময়ি
ত্বমেব সর্ব্বং সর্ব্বস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
দয়ারূপে দয়াদৃষ্টে দয়াদ্রে দুঃখমোচনি
সর্ব্বাপত্তারিকে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
অগম্য ধামাধামস্থে মহাযোগীশ হৃৎপুরে
অমেয় ভাব কূটস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
যঃ পঠেৎ স্তোত্রমেতত্তু পূজান্তে সাধক উত্তমঃ
সর্ব্ব পাপৎ বিনির্মুক্তঃ পূজা ফলং অবামুয়াৎ

ইতি শ্রীজগদ্ধাত্রীকল্পে জগদ্ধাত্রী স্তোত্রং সমাপ্তম্


কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...