Tuesday 28 July 2020

গার্গী বাচাক্নাবি

গার্গী বাচাক্নাবি
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০-৫০০ সালে মহাঋষি গর্গের বংশে জন্ম হয়েছিল বিদুষী গার্গীর আর তাই বলে এই বিদুষীর নাম রাখা হয়েছিল গার্গী। তিনি ঋষি বাচাক্নুর কন্যা। তাঁর পুরো নাম গার্গী বাচাক্নাবি। পিতার কাছেই শুরু হয়েছিল দর্শন শিক্ষা। দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করানো হয় বিজ্ঞান সাধনার সারিতে।
যাজ্ঞবল্ক্য-গার্গীর সেই কালজয়ী বিখ্যাত দার্শনিক তর্ক সর্বজনবিদিত। গার্গীর মতো অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানের অধিকারী নারীর পদচারণে মুখর ছিল পণ্ডিত আখড়া ও সভাস্থল।প্রাচীন ভারতের মিথিলা রাজ্যের রাজা জনক ছিলেন দর্শনের গুণগ্রাহী। রাজা জনক রাজসূয় যজ্ঞের পরে তাঁর রাজসভায় চারপাশ থেকে আসা আমন্ত্রিত পণ্ডিত বিদ্বান-দার্শনিকদের নিয়ে ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ নামে দার্শনিক বিতর্কের বিশাল আসর আয়োজন করলেন এবং তাতে গার্গী ছিলেন অন্যতমা অংশগ্রহণকারিনী।সেই সময় রাজা জনক ঘোষণা করলেন যিনি সবাইকে তর্কে পরাজিত করতে পারবেন তাঁকে তিনি এক হাজার গ্রাম এবং এক হাজার গাভী, যাদের শিঙ দুটি সোনায় মোড়া থাকবে,পুরষ্কার হিসেবে দান করবেন।“ব্রাহ্মণা ভগবন্তো যো বো ব্রহ্মিষ্ঠঃ স এতা উদজাতামিতি” - উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি নিয়ে যান এই গরুগুলি।এই শুনে তর্ক শুরুর আগেই ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর শিষ্য সৌম্য সামশ্রবঃ কে আদেশ দিলেন - সব গাভী তাঁর আশ্রমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এতে অন্যান্য দার্শনিকরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন। তার মানে কি এই যে যাজ্ঞবল্ক নিজেকে শ্রেষ্ঠতম দাবি করছেন কোনোরকম তর্ক বিতর্ক ছাড়াই কিন্তু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে যাজ্ঞবল্ক উত্তর দিলেন, নমঃ বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্মো, গোকামা এব বয়ং স্মঃ ইতি – বাপুরা, ব্রহ্মিষ্ঠকে নমস্কার করি, কিন্তু এই গরুগুলি আমার বিশেষ প্রয়োজন। শুনে অন্যান্য ঋষিরা জানান, গাভীর প্রয়োজন তাঁদের সকলেরই। কিন্তু সেটা নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে জিতে নিতে হবে।অবশেষে রাজা নিজেই বেছে ঠিক করলেন আটজন পণ্ডিতকে যাঁরা প্রশ্ন করবেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে এবং নির্ধারণ করবেন তিনিই শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত কিনা। এদের মধ্যে গার্গী ছিলেন একমাত্র নারী, বাকি সবাই পুরুষ। একে একে তখনকার দিনের সব বড় বড় পণ্ডিতেরা যেমন, অশ্বল, অর্থভাগ ভূজ্য, উদ্দালকূ উষস্ত-সহ সাত পুরুষ দার্শনিককে পরাস্ত করলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। শেষে পালা এলো গার্গীর। স্মিত মুখে গার্গী প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন- পরাজিত হলে হাসি মুখে মেনে নেবেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যর শ্রেষ্ঠত্ব। যাজ্ঞবল্ক্যকে হারানোর মতো পাণ্ডিত্য ভূ-ভারতে নেই, এইকথা সর্বজনবিদিত।যাজ্ঞবল্ককে হারাবার মতো পাণ্ডিত্য যে সত্যি বিরল, সেকথা ভালো করেই জানতেন গার্গী। তারপর শুরু হলো সেই সর্বকালের বিখ্যাত কথোপকথন।
এই সম্পূর্ণ পর্বে যাজ্ঞবল্ককে কিন্তু গার্গী শ্রদ্ধাভরে “হে ঋষি যাজ্ঞবল্ক” বলে সম্বোধন করেছেন, আর যাজ্ঞবল্কও গার্গীকে সমীহ করে “ভদ্রে বিদুষী গার্গী” বলে সম্বোধন করেছেন প্রতিবার।
গার্গী পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ব নিয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন,
গার্গী: সারা বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উপাদান বা একক একত্র হয়ে। বলুন জলের উপাদান বা একক কী, যা একত্র হয়ে সৃষ্টি হয়েছে জল?
যাজ্ঞবল্ক্য: জলের একক হল বাতাস।
গার্গী: বাতাস কী দিয়ে তৈরি?
যাজ্ঞবল্ক্য: বাতাসের উপাদান আকাশ।
গার্গী: আকাশের একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: আকাশের একক আদিত্য বা সূর্য।
গার্গী: তাহলে সূর্যের একক কী?
যাজ্ঞবক্য: চন্দ্র।
গার্গী: চন্দ্রের একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: চন্দ্রের একক নক্ষত্র।
গার্গী: নক্ষত্রের উপাদান কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: দেবতারা।
গার্গী: দেবতাদের উপাদান কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: তাঁদের উপাদান ইন্দ্র।
গার্গী: তাহলে আমাকে বলুন ইন্দ্রের উপাদান কী!
যাজ্ঞবল্ক্য: তাঁর উপাদান প্রজাপতি।
গার্গী: আমি জানতে চাই প্রজাপতির একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: তাঁর একক হল পরম ব্রহ্ম।
গার্গী: তাহলে আমি জানতে চাই ব্রহ্মের উপকরণ কী, অর্থাৎ সেটা এমন কী জিনিস যা পরস্পর একত্র হয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্রহ্মের?
এ কথার কোনো জবাব দেন না যাজ্ঞবল্ক। গার্গীর স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্বে তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর আর কোনো উত্তর নয়। রাগান্বিত যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, আপনি স্তব্ধ হন ভদ্রে। গার্গী, আর প্রশ্ন করবেন না। বেদের নিয়ম আপনি লঙ্ঘন করছেন। এরপরে জানতে চাইলে আপনার মাথা খসে পড়বে। আপনি মানসিক ভারসাম্য হারাবেন”। তবে যাজ্ঞবল্কের মতো প্রাজ্ঞ, পরিণত ঋষি গার্গীকে নারী হিসেবে না দেখে একজন সমকক্ষ ঋষি মনে করতে পারলে এমন ক্ষিপ্ত হতেন না, এমন কঠিন ভবিষৎবাণী বা অভিশাপও দিতে পারতেন না। ফলে যতোই বলা হোক প্রাচীনকালে নারীদের পুরুষের সমতুল্য জ্ঞান আহরণ ও পড়াশোনা, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার অধিকার ছিল, শাস্ত্রীয় বা সাহিত্যের চরিত্রগুলোতে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।
যাজ্ঞবল্কের কথায় স্তম্ভিত হয়ে আর কোনো কথা না বলে গার্গী বসে পড়লেন। তবে বসে বসেও শান্তি পান না গার্গী। অন্য যেসব পণ্ডিত ছিলেন বলেছি, আগেই যাজ্ঞবল্ককে প্রশ্ন করতে না করতেই পরাজয় স্বীকার করে নেন। তারপর উঠলেন উদ্দালক। তিনি বসতেই গার্গী আবার উঠলেন, যাজ্ঞবল্ক্যের সামনে দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়ানোর সাহস আর কারুরই হয়নি। তবে গার্গী ছিলেন অসামান্যা বেদজ্ঞানী। সভার সমস্ত পণ্ডিতদের প্রথমেই তিনি বলে দিলেন, দ্বৌ প্রশ্নৌ প্রক্ষ্যামি, তৌ চেন্মে বক্ষ্যতি, ন জাতু যুষ্মাকং কশ্চিদ্‌ ব্রহ্মোদ্যং জেতেতি – দুটি প্রশ্ন করব, এই দুই প্রশ্নের উত্তর যদি ইনি দিতে পারেন, তাহলে আপনারা কেউ ব্রহ্মবিদ্যায় পরাস্ত করতে পারবেন না। নিজের ধীশক্তির ওপর কি অসাধারণ বিশ্বাস, সভার তাবড় তাবড় পণ্ডিতদের মুখের ওপর বলে দিলেন আপনারা যতই প্রশ্ন করুন না কেন, আমার প্রশ্নই শেষ প্রশ্ন। তার পরে আর প্রশ্ন নিরর্থক। সভার সব পণ্ডিতেরা অনুমতি দিলে গার্গী প্রশ্ন করলেন- যাজ্ঞবল্ক্য, গার্গী জিজ্ঞাসা করলেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য, আমার প্রথম প্রশ্ন, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল কিসে অধিষ্ঠিত? এই দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যে, যা অতীত, যা বর্তমান, যা ভবিষ্যৎ রূপে বিদ্যমান, তা কিসে ওতঃপ্রোত আছে?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, এই সমস্তই আকাশে বা অনন্তে প্রতিষ্ঠিত।
সভাস্থ সকলের ধারণা ছিলো আকাশ বা অনন্তের ওপরে আর কি থাকতে পারে? কিন্তু বিদুষী গার্গী এখানেই থামলেন না আবার প্রশ্ন করলেন, আকাশ কিসে অধিষ্ঠিত?
তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য শোনালেন, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড যাতে অধিষ্ঠিত, সেই অবাঙ্‌মানসগোচর অক্ষর ব্রহ্মের কথা। যাঁকে কেউ দেখতে পান না, কিন্তু তিনি সব কিছুই দেখতে পান, যাঁকে কেউ শুনতে পান না, কিন্তু তিনি সবই শুনতে পান, যাঁকে কেউ জানতে পারেন না কিন্তু তিনি সবই জানতে পারেন, সেই অক্ষয় বা শাশ্বতই আকাশের ভিত্তি যাতে আকাশ ওতঃপ্রোত আছে। আর এই অক্ষয়ই হল পরম ব্রহ্ম। যার কোনো বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ-আকার-অবয়ব নেই। এই চির শাশ্বত বা অবিনশ্বর বা অক্ষয়ের নির্দেশে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহ নিজের স্থানে নিজের কাজে রত রয়েছে। এবং দীর্ঘ তপস্যার পরেও যদি সেই পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি না করা যায়, তাহলে সেই তপস্যা বৃথা। ‘নান্যদতোহস্তি দ্রষ্টূ, নান্যদতোহস্তি বিজ্ঞাত্রেতাস্মিন্’ – ইনি ভিন্ন কেউ দ্রষ্টা নেই, শ্রোতা নেই, বিজ্ঞাতা নেই।
এটাই চূড়ান্ত। এখানে যাজ্ঞবল্ক্যর উত্তর সমস্ত জ্ঞানের সীমানা অতিক্রম করে গেল। এই জ্ঞানই প্রকৃত অনন্ত বা ভূমা, যা ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে উল্লেখিত। যাজ্ঞবল্ক্য যে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী, এক প্রকৃষ্ট জ্ঞানযোগী, এই প্রশ্নের উত্তরে তা স্পষ্ট বোঝা গেল। গার্গী স্মিতমুখে পরাজয় মেনে নিয়ে বললেন- “যাজ্ঞবল্ক্য, তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই যিনি তোমাকে জয় করতে পারেন”।
সুত্রঃ- বৃহদারণ্যক উপনিষদ

Thursday 2 July 2020

আমাদের মন্ত্র কেন সংস্কৃতে হওয়া প্রয়োজন

আমাদের মন্ত্র কেন সংস্কৃতে হওয়া প্রয়োজন সেই বিষয়ে যাবার আগে একটু প্রাথমিক বিষয় ঝালিয়ে নিয়ে নেই। আমরা সকলেই জানি সকল ভাষার মধ্যে সংস্কৃত এমন এক ভাষা যা সবচাইতে সমৃদ্ধশালী। সংস্কৃতের বর্ণ সম্বন্ধে আগেই আলোচনা করেছি। সংস্কৃতে বর্ণ সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে, আমরা দেখতে পাই যে শিবসুত্রে মোট ৪৩টি বর্ণ আছে।পাণিনিয় শিক্ষাতে মোট ৬৩ বা ৬৪ টি বর্ণ আছে।ঋক প্রতিসাক্ষ্যতে মোট ৪৭টি বর্ণ আছে,তৈত্রীয় প্রতিসাক্ষ্যতে মোট ৫২টি বর্ণ আছে, বাস্বেন্যয়ী প্রতিসাক্ষ্যতে মোট ৬৫টি বর্ণ আছে য়ার ঋক তন্ত্রে মোট ৫৭টি বর্ণ আছে। তাহলে বর্ণ কি? খুব সহজভাবে বললে, প্রত্যেকটি ধ্বনি লিখে বুঝানোর জন্য যে চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাকেই বর্ণ বলা হয়। যেমন অ, আ, ক, খ ইত্যাদি।
এবার আসি অক্ষর কি?
নিঃশ্বাসের এক প্রয়াসে যতটুকু ধ্বনি উচ্চারিত হয় তাই অক্ষর বা নিঃশ্বাসের এক প্রয়াসে উচ্চারণযোগ্য শব্দের সবচেয়ে ছোট অংশ।
অতএব মন্ত্র হল কিছু বর্ণের দ্বারা তৈরী নির্ধারিত অক্ষর। আমরা যা বলি তাই মন্ত্র নয়, কিছু বিশিষ্ট বর্ণ দিয়ে অর্থপুর্ণ অক্ষর তৈরী করে দেবতার সাথে সাধকের সংযোগ স্থাপন করাই মন্ত্রের আসল উদ্দেশ্য। সেখানে আরেকটা জিনিষ উল্ল্যেখযোগ্য সেটা হলো ধ্বনি, ধ্বনি কাকে বলে?মানুষের বাক-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে উচ্চারিত আওয়াজকে ব্যাকরণে ধ্বনি বলে।মন্ত্রে ধ্বনির গুরুত্ব অনেক, যাকে ‘নাদ-ব্রহ্ম’ বলে। অক্ষর বা শব্দ-ব্রহ্মের সাথে নাদ-ব্রহ্মের মিলনে যে ভাব গম্ভীর পরিবেশের তৈরী হয়, সেখানেই সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্রের মাহাত্ম্য। সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্র গুলি এমন ভাবে গঠন করা হয়েছে যে প্রত্যেকটি মন্ত্রের এক একটি সঠিক তরঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং সেই তরঙ্গ ভক্ত হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে ভাব রসের বা ভক্তি রসের, পরিবেশ কে মধুময় ও আধ্যাত্মিক ভাবে উন্নিত করে তোলে। অবশ্য তার জন্যে সঠিক মন্ত্র ও বিশুদ্ধ উচ্চারণ একান্ত আবশ্যক।প্রাচীন কালের ঋষি-মুনিরা মন্ত্র দ্বারা তরঙ্গ সৃষ্টি সম্পর্কে জানতেন,তাই তরঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যই তাঁরা বিভিন্ন মন্ত্রের খোঁজ করেন। মন্ত্রের সঠিক উচ্চারণ মানব শরীরে ধনাত্মক শক্তির প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং মানব শরীর থেকে নির্গত তরঙ্গ সম্পর্কযুক্ত দৈবীয় তরঙ্গের সম্পর্কে এসে মানব মস্তিষ্কে ধনাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। তবে মন্ত্র উচ্চারনের শব্দের ক্রমে কোনও ত্রুটি থাকলে ঋণাত্মক প্রবাহও হতে পারে। মন্ত্র কে না জাগালে সেই মন্ত্রের সুফল ফলে না বরঞ্চ কুফল সৃষ্টি হয়। মন্ত্রকে জাগানো কে ‘মন্ত্র চৈতন্য’ বলে। সাধক যখন মন্ত্রের সঠিক অর্থ জেনে বিশুদ্ধ ভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করেন তখন অক্ষর-ব্রহ্ম ও শব্দ-ব্রহ্ম দুইই জাগরিত হয়।আর মন্ত্র জাগরিত হলে আশেপাশের পরিবেশ পবিত্র হয়ে উঠে এবং সেইসব মন্ত্রের সঠিক অর্থ বোধগম্য না হলেও সেই পরিবেশে উপস্থিত ভক্তমন্ডলীর হৃদয়ে ভাবের সৃষ্টি হয়। আশাকরি পাঠকবৃন্দ এতদিনে তা উপলব্ধি অবশ্যই করেছেন। আমরা মন্ত্র বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করি, পূজা-পার্বন, বিবাহ, শ্রাদ্ধাদিতে। লক্ষ্য করে দেখবেন যেখানে পূজা হয় সেখানে মন্ত্রের উচ্চারণ কালে ভাবরসের/ভক্তিরসের সৃষ্টি হয়, আবার যখন শ্রাদ্ধ-বাসরে মন্ত্র উচ্চারণ হয় তখন ক্রুণ-রসের সৃষ্টি হয় মনকে বিষাদময় করে তোলে, যদিও আমরা অনেক সময় মন্ত্রের অর্থ বুঝতে পারি না কিন্তু সেই সব মন্ত্রের প্রভাবে যে পরিবেশ তৈরী হয় সেটাই আমাদেরকে প্রভাবিত করে তোলে।
সংস্কৃত ভাষার লিপি হলো দেবনাগরী, যা আজকালের হিন্দী ভাষার লিপির সাথে মিলে যায়। প্রাচীন দেবনাগরী লিপির কিছু পার্থক্য আছে কিন্তু বর্তমানে তা পরিমার্জিত হয়েছে। আমি নীচে সেই বর্ণমালা দিলাম আপনাদের জ্ঞাতার্থে। প্রাচীন বর্নমালা লিখতে বেশ কষ্ট হতো কিন্তু বর্তমানের বর্ণমালা অনেক সহজ।আপনাদের জানিয়ে রাখি হিন্দীতে যে বর্ণমালা ব্যবহার হয় তা কিন্তু মূলত দেবনাগরীই। সেইরূপ বর্তমানে অনেক মন্ত্র গুলিও আধুনিক বর্ণে লিখিত। আমার জ্ঞান অনেক সীমিত তাই বেশী বিচার বিশ্লেষণে যাওয়ার ধৃষ্টতা করতে পারবো না। তবে এতটুকু বলি 'শিবমহিন্ম স্তোত্র' যা অনেক প্রাচীন যার প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করা আজও অনেক পন্ডিতের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে আছে, তেমনি অনেক গুঢ় শাস্ত্র আমাদের কাছে আজ ও অজানা হয়ে আছে। তাঁর কারন আমাদের সংস্কৃত ভাষা জ্ঞানের অভাব আর সেই সাথে আমাদের নিরুৎসাহতা । আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্র যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষবিজ্ঞান,অর্থশাস্ত্র,নীতিশাস্ত্র বিজ্ঞান শাস্ত্র ইত্যাদি অমূল্য গ্রন্থাবলীর প্রকৃত জ্ঞান-ভান্ডার আমাদের কাছে আজ ও অজানা রয়ে গেছে। আজ আমরা সেই সব শাস্ত্রের যতটুকু জানি সে তো সিকি ভাগও নয়। অযত্নে, অবহেলায় আর শত্রুর আক্রমণে অনেক মূল্যবান বই আজ আমাদের হাতছাড়া। আর এমন অনেক বই আজ বিদেশীদের কবলে, যারা এর প্রকৃত স্বাদ পেয়েছে এবং তাঁরা সেইজন্য সংস্কৃত শিখতে ব্রতী হয়েছে, আর আমরা আমাদের মিথ্যা অভিমান নিয়ে বসে আছি। আজ সংস্কৃত ভাষা ধর্মের মধ্যে চলে এসেছে আজ সংস্কৃত শিখতে চাইলেই ধর্ম-নিরপেক্ষতাতে আঘাত হানা হয়। যতদিন আমাদের এই মানসিকতা থাকবে,ততদিন এই ভাষা সুপ্তই থেকে যাবে। এখনো যদি আমরা জাগরিত না হই তা হলে সেই দিনের আর বেশী দূর না যে দিন এই ভাষা ভারতের বুক থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে আর আমাদের নিজের একান্ত আপন সেই ভাষা শেখাবে বিদেশীরা।
Image may contain: textNo photo description available.

মন্ত্র- কি ?
"মননাৎ ত্রায়তে যস্মাৎ তস্মাৎ মন্ত্র উদাহৃতঃ।" যার মননের দ্বারা, চিন্তার দ্বারা, ধ্যানের দ্বারা সংসার-সাগর থেকে উর্ত্তীর্ণ হওয়া যায়, দুঃখ-কষ্টের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পরমানন্দ প্রাপ্তি হয় তারই নাম মন্ত্র।মন্ত্র শব্দটি 'মন' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, মন থেকে মন্ত্র কথাটি এসেছে। মন্ত্র শব্দটির নির্বাচন সম্বন্ধে যাস্ক বলেন 'মনন হতে মন্ত্র শব্দের উৎপত্তি'। যা থেকে কোন কর্ম বা তার অনুষ্ঠানের উপযোগী উপকরনের দ্রব্য বা অনুষ্ঠানের ফলদাত্রী দেবতার মনন বা জ্ঞান জন্মে তাঁকেই মন্ত্র বলে। টীকাকার দূর্গাচার্য্য বলেছেন – ‘বেদের মন্ত্রসমুহ থেকে আধীদৈবিক, আধ্যাত্মিক ও আধিযাজ্ঞিক অর্থাৎ যজ্ঞ সংক্রান্ত বিষয়াবলীর মনন বা বোধ উৎপন্ন হয়। মন্ত্র সকল যথার্থ ভাবে বিনিযুক্ত হলে তবেই সেই মন্ত্রের প্রকৃত ফল লাভ হয়। এটাই মন্ত্রের মূল মন্ত্রত্ব।
মন্ত্র সেই মাধ্যম, যার দ্বারা বিভিন্ন দেবী-দেবতার আহ্বান করা হয়, এরফলে দেবী-দেবতা জাতকের শারীরিক, মানসিক, ভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশে ভারসাম্য স্থাপিত করে জাতকের জীবনকে সুখী করে তোলেন। মন্ত্র শাস্ত্রকে এক পূর্ণ বিকশিত আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। মন্ত্রের সঠিক নির্বাচন এবং সঠিক উচ্চারণ জাতকের শারীরিক, মানসিক, ভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশে ভারসাম্য স্থাপিত করে এবং জাতকের জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তি স্থাপিত করে।
মন্ত্র বহু প্রকারের হয়ে থাকে যদিও সকল প্রকার মন্ত্রের উদ্দেশ্য একই থাকে । বেদে বর্ণিত প্রতিটি মন্ত্র এক এক দেবতার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন প্রতিটি মন্ত্রের মধ্যে তিনটি অংশ থাকে,-প্রণব, বীজ ও দেবতা। একাক্ষর মন্ত্রগুলির মধ্যেও এই তিন তত্ত্ব নিহিত। প্রণব সর্ব্বব্যাপী ভগবৎ-তত্ত্ব প্রকাশ করে, বীজ ব্যষ্টি-জীবনের লক্ষ্য নির্দ্ধারিত করে, দেবতা সেই লক্ষ্যপ্রাপ্তির উপায় জানিয়ে দেয়। আমাদের প্রণব মন্ত্র 'ওঁ' কারের মধ্যে অতিসুন্দরভাবে সর্ব্বব্যাপী ভগবৎ-তত্ত্ব-পরমাত্মা-তত্ত্ব নিহিত আছে । বীজের মধ্যে ব্যষ্টি-ভাবাপন্ন প্রত্যক্‌-চৈতন্যের সব তত্ত্ব নিহিত থাকে আর দেবতাতত্ত্বের মধ্যে কিরুপে আমাদের ভিতরকার অন্তরেন্দ্রিয়, বহিরিন্দ্রিয় ও দেহাদির সব তত্ত্বের মধ্য দিয়ে সেই প্রত্যক্‌-চৈতন্য পূর্ণভাবে পরিণতি লাভ করতে পারে, সেই সব তত্ত্ব নিহিত আছে। ভগবৎ-চৈতন্য প্রকৃতির সব স্তরের মধ্য দিয়ে কিভাবে প্রকাশ পায়, লীলা করে-সেই সব নিয়ে দেবতাতত্ত্ব। দেবতা সাক্ষাৎকার করার অর্থ-সেই সব তত্ত্বগুলির মধ্য দিয়ে ব্যষ্টি-সমষ্টি ভাবে ভগবৎ-চৈতন্যকে অবাধিত ভাবে ফুটিয়ে বাহির করা-উপলব্ধি করা।
ওম শব্দটি সংস্কৃতে ‘অব’ ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে, এই ‘ওম’ এমন একটি অক্ষর এমন একটি শক্তি যা সর্বজ্ঞ, সমগ্র ব্রহ্মান্ডের শাসন কর্তা, রক্ষাকর্তা, মনোবাঞ্ছাপূর্ণকারী, অজ্ঞাননাশক ও জ্ঞানপ্রদায়ক। ওম তিন মাত্রাযুক্ত তাই ‘ওম’ কারকে ত্র্যক্ষর মন্ত্র বলা হয়, ওম- কারের ভিতরে আমরা 'অ'কার 'উ'কার ও 'ম'কার এবং অর্দ্ধমাত্রা এই তত্ত্বগুলি দেখিতে পাই। ভগবানের একাংশ ব্যক্ত জগৎরূপে সৃষ্ট পরিণত বা বিবর্ত্তিত; অপরাংশ অব্যক্ত ইহাই অর্দ্ধমাত্রা। ‘অ’ কার আপ্তি বা আদিম তত্ত্ব যা আরম্ভ বা সৃষ্টির প্রতীক, ‘উ’ কার ‘উৎকর্ষ’ বা অভেদ তত্ত্বের প্রতীক আর ‘ম’ কার ‘মিতি’ বা অপীতি অর্থাৎ লয়ের প্রতীক। সেই অর্থে ‘ওম’ কার সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের অধীশ্বর দেবতার প্রতীক। ওম কার সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের প্রতীক। আমাদের সনাতন ধর্মের সকল মন্ত্র এই ওম-কার দিয়ে শুরু হয়। তার কারন ওঁকারের মধ্যে অতিসুন্দরভাবে সর্ব্বব্যাপী ভগবৎ-তত্ত্ব-পরমাত্মা-তত্ত্ব নিহিত। স্বামী বিবেকানন্দ বল্রছেন ‘ওম’ হলো সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের প্রতীক। এই ‘ওম’কার মনের যাবতীয় চঞ্চলতা ও ব্যাকুলতা উদ্ধার করে। মানসিক উন্নতির জন্যে এই ওম কারের গ্রুত্ব অপরিসীম। ওঁ কারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ওঁ মহেশ্বর এই তিঞ্জনকেই একত্রে স্মরন করা হয়, তাই কোন মন্ত্রের আগে ওঁ সংযোগ করে এই তিনজনকে স্মরন করা হয়। আব্র যেহেতু ওঁ ধ্বনি এই বিশ্বের আদি ধ্বনি তাই প্রতি মন্ত্রের পূর্বে ওঁ সংযোগ করে সেই মন্ত্র কে জগতের সাথে সংযোগ করা হয়।

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...