Tuesday 28 July 2020

গার্গী বাচাক্নাবি

গার্গী বাচাক্নাবি
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০-৫০০ সালে মহাঋষি গর্গের বংশে জন্ম হয়েছিল বিদুষী গার্গীর আর তাই বলে এই বিদুষীর নাম রাখা হয়েছিল গার্গী। তিনি ঋষি বাচাক্নুর কন্যা। তাঁর পুরো নাম গার্গী বাচাক্নাবি। পিতার কাছেই শুরু হয়েছিল দর্শন শিক্ষা। দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করানো হয় বিজ্ঞান সাধনার সারিতে।
যাজ্ঞবল্ক্য-গার্গীর সেই কালজয়ী বিখ্যাত দার্শনিক তর্ক সর্বজনবিদিত। গার্গীর মতো অসাধারণ বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানের অধিকারী নারীর পদচারণে মুখর ছিল পণ্ডিত আখড়া ও সভাস্থল।প্রাচীন ভারতের মিথিলা রাজ্যের রাজা জনক ছিলেন দর্শনের গুণগ্রাহী। রাজা জনক রাজসূয় যজ্ঞের পরে তাঁর রাজসভায় চারপাশ থেকে আসা আমন্ত্রিত পণ্ডিত বিদ্বান-দার্শনিকদের নিয়ে ‘ব্রহ্মজ্ঞান’ নামে দার্শনিক বিতর্কের বিশাল আসর আয়োজন করলেন এবং তাতে গার্গী ছিলেন অন্যতমা অংশগ্রহণকারিনী।সেই সময় রাজা জনক ঘোষণা করলেন যিনি সবাইকে তর্কে পরাজিত করতে পারবেন তাঁকে তিনি এক হাজার গ্রাম এবং এক হাজার গাভী, যাদের শিঙ দুটি সোনায় মোড়া থাকবে,পুরষ্কার হিসেবে দান করবেন।“ব্রাহ্মণা ভগবন্তো যো বো ব্রহ্মিষ্ঠঃ স এতা উদজাতামিতি” - উপস্থিত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি নিয়ে যান এই গরুগুলি।এই শুনে তর্ক শুরুর আগেই ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর শিষ্য সৌম্য সামশ্রবঃ কে আদেশ দিলেন - সব গাভী তাঁর আশ্রমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এতে অন্যান্য দার্শনিকরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেন। তার মানে কি এই যে যাজ্ঞবল্ক নিজেকে শ্রেষ্ঠতম দাবি করছেন কোনোরকম তর্ক বিতর্ক ছাড়াই কিন্তু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে যাজ্ঞবল্ক উত্তর দিলেন, নমঃ বয়ং ব্রহ্মিষ্ঠায় কুর্মো, গোকামা এব বয়ং স্মঃ ইতি – বাপুরা, ব্রহ্মিষ্ঠকে নমস্কার করি, কিন্তু এই গরুগুলি আমার বিশেষ প্রয়োজন। শুনে অন্যান্য ঋষিরা জানান, গাভীর প্রয়োজন তাঁদের সকলেরই। কিন্তু সেটা নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে জিতে নিতে হবে।অবশেষে রাজা নিজেই বেছে ঠিক করলেন আটজন পণ্ডিতকে যাঁরা প্রশ্ন করবেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে এবং নির্ধারণ করবেন তিনিই শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত কিনা। এদের মধ্যে গার্গী ছিলেন একমাত্র নারী, বাকি সবাই পুরুষ। একে একে তখনকার দিনের সব বড় বড় পণ্ডিতেরা যেমন, অশ্বল, অর্থভাগ ভূজ্য, উদ্দালকূ উষস্ত-সহ সাত পুরুষ দার্শনিককে পরাস্ত করলেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য। শেষে পালা এলো গার্গীর। স্মিত মুখে গার্গী প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন- পরাজিত হলে হাসি মুখে মেনে নেবেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যর শ্রেষ্ঠত্ব। যাজ্ঞবল্ক্যকে হারানোর মতো পাণ্ডিত্য ভূ-ভারতে নেই, এইকথা সর্বজনবিদিত।যাজ্ঞবল্ককে হারাবার মতো পাণ্ডিত্য যে সত্যি বিরল, সেকথা ভালো করেই জানতেন গার্গী। তারপর শুরু হলো সেই সর্বকালের বিখ্যাত কথোপকথন।
এই সম্পূর্ণ পর্বে যাজ্ঞবল্ককে কিন্তু গার্গী শ্রদ্ধাভরে “হে ঋষি যাজ্ঞবল্ক” বলে সম্বোধন করেছেন, আর যাজ্ঞবল্কও গার্গীকে সমীহ করে “ভদ্রে বিদুষী গার্গী” বলে সম্বোধন করেছেন প্রতিবার।
গার্গী পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ব নিয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন,
গার্গী: সারা বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উপাদান বা একক একত্র হয়ে। বলুন জলের উপাদান বা একক কী, যা একত্র হয়ে সৃষ্টি হয়েছে জল?
যাজ্ঞবল্ক্য: জলের একক হল বাতাস।
গার্গী: বাতাস কী দিয়ে তৈরি?
যাজ্ঞবল্ক্য: বাতাসের উপাদান আকাশ।
গার্গী: আকাশের একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: আকাশের একক আদিত্য বা সূর্য।
গার্গী: তাহলে সূর্যের একক কী?
যাজ্ঞবক্য: চন্দ্র।
গার্গী: চন্দ্রের একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: চন্দ্রের একক নক্ষত্র।
গার্গী: নক্ষত্রের উপাদান কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: দেবতারা।
গার্গী: দেবতাদের উপাদান কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: তাঁদের উপাদান ইন্দ্র।
গার্গী: তাহলে আমাকে বলুন ইন্দ্রের উপাদান কী!
যাজ্ঞবল্ক্য: তাঁর উপাদান প্রজাপতি।
গার্গী: আমি জানতে চাই প্রজাপতির একক কী?
যাজ্ঞবল্ক্য: তাঁর একক হল পরম ব্রহ্ম।
গার্গী: তাহলে আমি জানতে চাই ব্রহ্মের উপকরণ কী, অর্থাৎ সেটা এমন কী জিনিস যা পরস্পর একত্র হয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্রহ্মের?
এ কথার কোনো জবাব দেন না যাজ্ঞবল্ক। গার্গীর স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্বে তিনি ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর আর কোনো উত্তর নয়। রাগান্বিত যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, আপনি স্তব্ধ হন ভদ্রে। গার্গী, আর প্রশ্ন করবেন না। বেদের নিয়ম আপনি লঙ্ঘন করছেন। এরপরে জানতে চাইলে আপনার মাথা খসে পড়বে। আপনি মানসিক ভারসাম্য হারাবেন”। তবে যাজ্ঞবল্কের মতো প্রাজ্ঞ, পরিণত ঋষি গার্গীকে নারী হিসেবে না দেখে একজন সমকক্ষ ঋষি মনে করতে পারলে এমন ক্ষিপ্ত হতেন না, এমন কঠিন ভবিষৎবাণী বা অভিশাপও দিতে পারতেন না। ফলে যতোই বলা হোক প্রাচীনকালে নারীদের পুরুষের সমতুল্য জ্ঞান আহরণ ও পড়াশোনা, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার অধিকার ছিল, শাস্ত্রীয় বা সাহিত্যের চরিত্রগুলোতে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।
যাজ্ঞবল্কের কথায় স্তম্ভিত হয়ে আর কোনো কথা না বলে গার্গী বসে পড়লেন। তবে বসে বসেও শান্তি পান না গার্গী। অন্য যেসব পণ্ডিত ছিলেন বলেছি, আগেই যাজ্ঞবল্ককে প্রশ্ন করতে না করতেই পরাজয় স্বীকার করে নেন। তারপর উঠলেন উদ্দালক। তিনি বসতেই গার্গী আবার উঠলেন, যাজ্ঞবল্ক্যের সামনে দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়ানোর সাহস আর কারুরই হয়নি। তবে গার্গী ছিলেন অসামান্যা বেদজ্ঞানী। সভার সমস্ত পণ্ডিতদের প্রথমেই তিনি বলে দিলেন, দ্বৌ প্রশ্নৌ প্রক্ষ্যামি, তৌ চেন্মে বক্ষ্যতি, ন জাতু যুষ্মাকং কশ্চিদ্‌ ব্রহ্মোদ্যং জেতেতি – দুটি প্রশ্ন করব, এই দুই প্রশ্নের উত্তর যদি ইনি দিতে পারেন, তাহলে আপনারা কেউ ব্রহ্মবিদ্যায় পরাস্ত করতে পারবেন না। নিজের ধীশক্তির ওপর কি অসাধারণ বিশ্বাস, সভার তাবড় তাবড় পণ্ডিতদের মুখের ওপর বলে দিলেন আপনারা যতই প্রশ্ন করুন না কেন, আমার প্রশ্নই শেষ প্রশ্ন। তার পরে আর প্রশ্ন নিরর্থক। সভার সব পণ্ডিতেরা অনুমতি দিলে গার্গী প্রশ্ন করলেন- যাজ্ঞবল্ক্য, গার্গী জিজ্ঞাসা করলেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য, আমার প্রথম প্রশ্ন, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল কিসে অধিষ্ঠিত? এই দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যে, যা অতীত, যা বর্তমান, যা ভবিষ্যৎ রূপে বিদ্যমান, তা কিসে ওতঃপ্রোত আছে?
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, এই সমস্তই আকাশে বা অনন্তে প্রতিষ্ঠিত।
সভাস্থ সকলের ধারণা ছিলো আকাশ বা অনন্তের ওপরে আর কি থাকতে পারে? কিন্তু বিদুষী গার্গী এখানেই থামলেন না আবার প্রশ্ন করলেন, আকাশ কিসে অধিষ্ঠিত?
তার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য শোনালেন, সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড যাতে অধিষ্ঠিত, সেই অবাঙ্‌মানসগোচর অক্ষর ব্রহ্মের কথা। যাঁকে কেউ দেখতে পান না, কিন্তু তিনি সব কিছুই দেখতে পান, যাঁকে কেউ শুনতে পান না, কিন্তু তিনি সবই শুনতে পান, যাঁকে কেউ জানতে পারেন না কিন্তু তিনি সবই জানতে পারেন, সেই অক্ষয় বা শাশ্বতই আকাশের ভিত্তি যাতে আকাশ ওতঃপ্রোত আছে। আর এই অক্ষয়ই হল পরম ব্রহ্ম। যার কোনো বর্ণ-গন্ধ-স্বাদ-আকার-অবয়ব নেই। এই চির শাশ্বত বা অবিনশ্বর বা অক্ষয়ের নির্দেশে চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র-গ্রহ-উপগ্রহ নিজের স্থানে নিজের কাজে রত রয়েছে। এবং দীর্ঘ তপস্যার পরেও যদি সেই পরম ব্রহ্মকে উপলব্ধি না করা যায়, তাহলে সেই তপস্যা বৃথা। ‘নান্যদতোহস্তি দ্রষ্টূ, নান্যদতোহস্তি বিজ্ঞাত্রেতাস্মিন্’ – ইনি ভিন্ন কেউ দ্রষ্টা নেই, শ্রোতা নেই, বিজ্ঞাতা নেই।
এটাই চূড়ান্ত। এখানে যাজ্ঞবল্ক্যর উত্তর সমস্ত জ্ঞানের সীমানা অতিক্রম করে গেল। এই জ্ঞানই প্রকৃত অনন্ত বা ভূমা, যা ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে উল্লেখিত। যাজ্ঞবল্ক্য যে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী, এক প্রকৃষ্ট জ্ঞানযোগী, এই প্রশ্নের উত্তরে তা স্পষ্ট বোঝা গেল। গার্গী স্মিতমুখে পরাজয় মেনে নিয়ে বললেন- “যাজ্ঞবল্ক্য, তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ, আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই যিনি তোমাকে জয় করতে পারেন”।
সুত্রঃ- বৃহদারণ্যক উপনিষদ

No comments:

Post a Comment

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...