Tuesday 17 July 2018

মা ষষ্ঠী---পৌরানিক না লৌকিক দেবী.......... শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

ছবি সৌজন্যেঃ গুগোল


কিছু দিন আগেই গেলো বাঙ্গালী দের ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত বহু প্রচলিত অনুষ্ঠান অরণ্যষষ্ঠী পূজা, এই ষষ্ঠী পূজাকে সাধারণত জামাই ষষ্ঠী বলা হয়ে থাকে...অধিকাংশ বাঙ্গালী দের ঘরে ঘরে এই পূজা হয়েছে , আবার এই বছর ষষ্ঠীপূজা নিয়ে অনেকের মনে সংশয়ও ছিলো...।তার কারণ আষাঢ় মাস বলে......অনেকের ধারনা আষাঢ় মাসের দুর্বা বুঝি পুজায় আসে না...... অনেকের মতে এই মাসে দূর্বার জল বুঝি মাথায় নিতে নেই।তবে একথা আমাদের জেনে রাখা ভালো যে আমাদের অধিকাংশ পূজা চান্দ্র মাস অনুসারে হয়,তাই এইবার দিন অনুযায়ী আষাঢ় মাস হলেও চান্দ্রমাসানুসারে ছিল জৈষ্ঠ্য মাস আর জামাইষষ্ঠি চান্দ্র জ্যৈষ্ঠ মাসেই হয় তাই দূর্বা নির্বিবাদে ব্যাবহার করা যেতে পারে। বেদে বা পূরাণে ষষ্ঠী দেবীর কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, বেদে ব্রতেরও কোন বিধান পাওয়া যায় না তবে কি ষষ্ঠী দেবী কোন লৌকিক দেবী?
পুরাতন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটে, কিছুক্ষেত্রে ভয়ভীতি আবার কিছু ক্ষেত্রে আনন্দউচ্ছাস প্রকাশের ফল স্বরূপ। যাদের কে আবার দুইভাগ করা যায় দৈবিক ও লৌকিক। লৌকিক দেবদেবীরা লোকসমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত,এদের মধ্যে কারো বা নির্দিষ্ঠ মুর্ত্তি আছে কারো বা প্রতীকী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে গাছ বা পাথর বা অন্য কিছু......ঠিক একই প্রকার আমাদের এই ষষ্ঠীপূজা সন্তানপ্রদায়িনী ও সন্তানের রক্ষার জন্যে মা ষষ্ঠী বিশেষতঃ বাংলায় ঘরে ঘরে পুজিতা।    
ষষ্ঠী দেবী বিশেষত আমাদের গ্রাম্যজীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। ষষ্ঠী শব্দটি এসেছে ষষ্ঠ মানে ছয়, প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর আরাধনা করা হয় । স্কন্দ পুরাণ অনুযায়ী দেবী ষষ্ঠী হলেন ব্রহ্মার মানস কন্যা যার অপর নাম দেবসেনা ও কার্তিকের স্ত্রী। আবার মতান্তরে যেহেতু ষষ্ঠী হলেন  দেবী দূর্গার অপর এক রূপ তাই কার্তিকের জননী বা কাত্যায়নী। তাঁর পরিচিতি মিলেছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ও দেবী ভাগবতে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেবীর ভক্ত হিসেবে পরিচিত রাজা প্রিয়ব্রত যিনি ষষ্ঠী পুজো করে তাঁর মৃত সন্তানদের জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলেন।আর প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সেই থেকেই নাকি হিন্দু সমাজে প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠীপুজো প্রচলিত হয়েছে। দেবী ষষ্ঠী সন্তান দায়িনী,সন্তান পালিনী দেবী। বিভিন্ন পুরাণে বর্নিত থাকলেও তিনি কিন্তু বৈদিক দেবী নন আবার তিনি শুধু পৌরাণিক দেবী ও  নন তিনি হলেন লোকদেবী বা আরও প্রাচীন বিভিন্ন ব্রতের দেবী। তাঁকে দেবী দুর্গার সাথে  একীভূত করা হয়েছে। হয়তো বা এইজন্যে মহাষষ্ঠীর সকালেই হয় দেবী দুর্গার সংকল্প।প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতানুযায়ী সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই সমাজে শিশুরক্ষক দেবীর অস্তিত্ব ছিল।হরপ্পা সভ্যতায় কতকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে।এই দেবীরা ছিলেন মূলত গৃহদেবী।অন্যদিকে নবজাত শিশুর রক্ষয়িত্রী।পরবর্তীকালে এই সমস্ত মাতৃকামূর্তি থেকেই ষষ্ঠীর উদ্ভব।কিন্তু এও ঠিক যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে ষষ্ঠী্র মূর্তি বিশেষ একটা মেলেনি।কবি কৃষ্ণরাম দাসের ষষ্ঠী্মঙ্গলকাব্যের উল্ল্যেখ করে ড.সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন --উড়িষ্যায় বালেশ্বর জেলা থেকে একটি ষষ্ঠী মূর্তি মিলেছে।দেবীর কোলে শিশুসন্তান।বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ো ও সোনামুখিতে স্থানীয় কুম্ভকারেরা এক ধরণের মাটির পুতুল তৈরী করেন যার নাম ষষ্ঠীপুতুল বা যো পুতুল।এগুলি ষষ্ঠীতলায় মানত হিসাবে দেওয়া হয়। ষষ্ঠীর কোলে এক বা দুই কিম্বা দশের অধিক শিশু থাকে।কালো বা লাল দু'রঙেরই হয়।চোখে মুখে গড়নে প্রত্ন পুতুলের মায়াবি বিন্যাস ও আদিমতার ছাপ।সুতরাং ষষ্ঠীর উপস্থিতি সেই সুপ্রাচীনকালেই।আজও যার অস্তিত্ব টিকে আছে বাংলার পুতুল শিল্পে।
পৌরাণিক দেবী হিসাবে ষষ্ঠী -দুর্গা,লক্ষ্মী,সরস্বতীর মতোই এতে কোন পার্থক্য নেই।তাঁর ধ্যানমন্ত্রের সার কথা হল-গৌরবর্ণা দ্বিভূজা দেবী,উত্তম বসন ও অলঙ্কার পরিহিতা, চন্দ্রাননা ও কৃষ্ণমার্জার বাহনা,পীনোন্নত পয়োধরা।কোলে একাধিক শিশুপুত্র। স্বামী নির্মলানন্দ তাঁর 'দেব-দেবী ও তাদের বাহন'গ্রন্থে লিখেছেন যে বিড়াল হলো প্রজনন শক্তির প্রতীক। প্রাচীন লোকবিশ্বাস অনুযায়ী বিড়ালির দুধ স্ত্রীরোগের ঔষুধি হিসেবে কাজ করে এবং এই সুত্র ধরেই নাকি ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল।
মা ষষ্ঠী যেহেতু শিশু রক্ষয়ত্রী ও সন্তানপ্রদায়িনী তাই এই ব্রতের মূল লক্ষ্য হল সন্তানের মঙ্গলকামনা। তাই বারো মাসে বারোটি শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন ষষ্ঠীব্রতের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রকারে সন্তানের মঙ্গল কামনা,আয়ু বৃদ্ধি, ও সুস্বাস্থের  জন্যে মায়েরা ব্রত রাখেন। সন্তানের জন্মের ষষ্ঠ দিনে যে ষষ্ঠী পুজা করা হয় তা সূতিকা ষষ্ঠীবা ঘাটষষ্ঠী নামে পরিচিত। জন্মের একুশ দিনে আবার যে ষষ্ঠীর পূজা হয় তা একুশে, একুশ্যা বা শুদ্ধষষ্ঠী বলে।
তাছাড়াও বারোমাসে শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে বারটি ভিন্ন নামে ষষ্ঠী পূজা হয়।স্থানভেদে এই পূজা আবার বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন
Ø বৈশাখ মাসেঃ- ধুলাষষ্ঠী, চন্দনষষ্ঠী বা চান্দনী ষষ্ঠী
Ø  জ্যৈষ্ঠমাসেঃ-জামাইষষ্ঠী,অরণ্যষষ্ঠী,স্কন্দষষ্ঠী,বাটাষষ্ঠী
Ø আষাঢ়মাসেঃ- কোড়াষষ্ঠী,কদমষষ্ঠী,কার্দমীষষ্ঠী,কর্দ্দমষষ্ঠী(বিপত্তারিণী)
Ø শ্রাবণমাসেঃ- লোটনষষ্ঠী, লুণ্ঠনষষ্ঠী
Ø ভাদ্রমাসেঃ- মাথানীষষ্ঠী,মন্থনষষ্ঠী,চর্পটাষষ্ঠী,চাপড়াষষ্ঠী, সূর্যষষ্ঠী,অক্ষয়ষষ্ঠী,সরদেশীষষ্ঠী,
Ø আশ্বিনমাসেঃ- দূর্গাষষ্ঠী,বোধনষষ্ঠী
Ø কার্ত্তিকমাসেঃ- কার্ত্তিকষষ্ঠী, নাড়ীষষ্ঠী(ছট পূজা)
Ø অগ্রহায়ণ মাসেঃ- মূলাষষ্ঠী,গুহাষষ্ঠী,মূলকষষ্ঠী,মূলকরূপিণীষষ্ঠী
Ø পৌষমাসেঃ-পাটাইষষ্ঠী,অন্নরূপাষষ্ঠী
Ø মাঘমাসেঃ- শীতলষষ্ঠী
Ø ফাল্গুনমাসেঃ-অষোকষষ্ঠী,গোরূপিণীষষ্ঠী
Ø চৈত্র মাসেঃ- নীলষষ্ঠী,স্কন্দষষ্ঠী।
বারোমাসে বারোটি ষষ্ঠীব্রতের মাধ্যমে এটাই পরিলক্ষিত হয় যে মা ষষ্ঠী মাদূর্গারই এক অন্যরূপ যা মানব্জাতির লোকসমাজে এক অতি প্রিয় পরিচিতি। তিনি বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা যিনি সংসারের শিশুদের রক্ষার দায়িত্বভার নিয়েছেন। এক সাধারণ পরিবার সারাবছর যা আহার করে থাকেন মাষষ্ঠীর ভোগেও তাই দেওয়া হয়, কেনই বা দেওয়া হবে না তিনি যে সংসারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। একনজরে দেখে নেই কি ভাবে মাষষ্ঠীর আহার মাস ভেদে পরিবর্তন হয়...... বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে মাকে দেওয়া হয় আম-কাঠাল সহ বিভিন্ন ফলমূল,  আষাঢ় মাসে তেরোফল,তেরোপান,তেরোটি সুপারী, তেরোটি লুচি দিয়ে......শ্রাবণমাসে ঘি,আখের গুড়,ফল,মিষ্টি,ডাব, ঝিঙ্গে,ইত্যাদি...ভাদ্রমাসে চালেরগুড়োর সাথে তাল মিলিয়ে পিঠে,আশ্বিন মাসে আবার ফল-মূল নৈবেদ্য, কার্তিকমাসে  বিভিন্ন শাক-সব্জী,কলার কাদি,আখ ইত্যাদি গোটা জিনিষ,অগ্রহায়ন মাসে একুশটি করে পিঠে,পাটালী,হিমচে আর দেওয়া হয় গুড়াধান, আউশ ধান, পৌষ মাসে পায়েস-পিঠে,মাঘ মাসে ঠান্ডা জিনিষ ও গোটা সেদ্ধ,ফাল্গুন মাসে অশোক ফুল দিয়ে পূজা করা হয় আর চৈত্র মাসে অশোককুড়ি,মুগকলাই,দই।পাকা কলা,লুচি,সুজি ইত্যাদি তবে ভাত খাওয়া চলবে না।
মায়েদের কাছে সন্তানের নির্বিঘ্নে জন্ম ও তাঁর সুরক্ষা এক অতি বিশিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং হয়তো তার জন্যেই অতিমানসে জন্ম নিয়েছেন মাষষ্ঠীর মতো এক দেবী যিনি সন্তানদের আগলে রাখেন এবং সেই দেবীকে খুশী রাখতেই বারো মাসে বিভিন্ন নামে...বিভিন্ন রূপে...বিভিন্ন উপকরণে তার উপাসনা করা হয়ে থাকে। তবে এও সত্যি যে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা,বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, আধুনিক জীবন যাত্রার প্রভাবে এইসব ব্রতাচার......লোকাচার শহরাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেলেও.........গ্রামাঞ্চলে আজও তা বজায় আছে। আজও গ্রামাঞ্চলে বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে এইসব লৌকিক দেবী সাদরে পূজিতা।
আজ এখানেই আমার কলমের ইতি টানছি.........আগামীতে আপনাদের সহযোগিতা পেলে আরো নুতন নুতন বিষয় নিয়ে আপনাদের কাছে আবার আসবো এই আশা রইলো। ভালো থাকবেন.........সুখে থাকবেন।    

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...