Saturday 19 June 2021

দশহরা বা গঙ্গা পূজা

 দশহরা বা গঙ্গা পূজা






গামীকাল জ্যৈষ্ঠ  মাসের শুক্লা দশমী,  দশহরা বা গঙ্গা পূজা।এই দিনই রাজা ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মা গঙ্গা পৃথিবীতে নেমে আসেন। সেই দিনের তিথি ছিল জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা দশমী। স্কন্ধপুরাণে আছে এই দিনে গঙ্গায় স্নান করে, গঙ্গাকে দশটি ফুল, দশটি ফল ও দশটি প্রদীপ দিয়ে পুজো করলে আমাদের জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করা দশটি পাপ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। দশ পাপ হরণ হয় বলেই এই তিথি কৃত্যের নাম দশহরা, এ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিথি।
আসুন দেখে নেই এই দশপ্রকার পাপ কি? কি? যা থেকে এই দিনে মুক্তিলাভ সম্ভব
পরদ্রব্য হরণ, অযথা হিংসা অর্থাৎ বৃথা প্রাণী হত্যা ও পরদার গমন অর্থাৎ অবৈধ প্রণয় এই তিনটি হলো আমাদের দেহগত পাপ। অহংকারী বাক্য, মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা এবং অসংবদ্ধ প্রলাপ বা বাজে বকা— এই চারটি হলো আমাদের বাক্যগত পাপ।মনে মনে পরের দ্রব্যের কামনা, পরের অনিষ্ট চিন্তা এবং মিথ্যার প্রতি আসক্তি— এই তিনটি হলো আমাদের মানসিক পাপ।
গঙ্গা নদীর বর্ণনা আমরা বৈদিক যুগ থেকেই পাই, পুরাণ মতে গঙ্গা স্বর্গের দেবী।তপস্যার দ্বারা এই দেবীকে মর্তে এনেছিলেন সগর রাজার বংশজ রাজা ভগীরথ, যিনি আবার ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। পৌরাণিক আখ্যানে আছে সগর রাজার ছিলো ষাট হাজার পুত্র, কিন্তু সকলেই তাঁদের পাপকর্মের ফলে মহাসাধক কপিল মুনির অভিশাপে পড়েন এবং যোগবলে কপিলমুনি তাঁদের সকলকে ভস্ম করে দেন। কপিল মুনির অভিশাপে ভস্ম হলে,তাদের মুক্তিলাভের জন্য স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে আনতে দেবী গঙ্গার তপস্যা করতে করতে একে একে রাজা সগর, অসমঞ্জ, অংশুমান, দিলীপ রাজা দেহ ত্যাগ করেন,অবশেষে দিলীপ পুত্র ভগীরথ সফল হয়ে গঙ্গাকে মর্তে আনতে পারেন। সেইদিন ছিলো জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা দশমী।
বৈদিক যুগের কোনও এক সময়ে দশহরা তিথি থেকেই বৎসর গণনা শুরু হতো তাই দশহরা সেদিন নববর্ষের পূর্ণ মর্যাদায় ছিলো। দশহরার প্রধান কাজ হলো গঙ্গায় স্নান করা, কিন্তু যারা দূরে আছেন বা বিভিন্ন কারনে অক্ষম তাঁরা কি করবেন??? নিজের স্নানের জলে দু-তিন ফোঁটা গঙ্গা জল মিশিয়ে এই মন্ত্র
‘নমঃ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু

পাঠ করুন, বিশ্বাস এই মন্ত্রের সাহায্যে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, ও কাবেরীকে স্মরণ করে স্নানের জলে এই নদীগুলির পবিত্রতা ও শুদ্ধতা এনে নিজের জীবন কে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ করা যায়। পরে হাতজোড় করে
‘নমঃ কুরুক্ষেত্র গয়া গঙ্গা প্রভাস পুষ্করিণী চ
তীর্থান্যেতানি পুণ্যানি স্নানকালে ভবন্ত্বিহ’

এই বলে স্নান করে নিন, গঙ্গা স্নান হয়ে যাবে। অবশ্য এতে আস্থা থাকা চাই, কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
ভালো থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী
৪ই আষাঢ়,১৪২৮বঙ্গাব্দ
১৯শে জুন,২০২১ইং
ছবিঃ-সৌজন্যেঃ গুগোল

Tuesday 8 June 2021

সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রত


ছবিঃগুগল চিত্র

প্রসঙ্গঃ সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রত
আজ থেকে শুরু হয়েছে সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রত, এই তিনদিন দেবী সাবিত্রী, সাবিত্রী সত্যবান ও ধর্মরাজের পূজা হয়ে থাকে। সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রতকথা অনুযায়ী -- মদ্র দেশের রাজা ছিলেন অশ্বপতি এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন মালবী। তাঁদের কোন সন্তানাদি ছিলো না, তাই সন্তানের প্রত্যাশায় তাঁরা দেবীসাবিত্রীর আরাধনা করতে লাগলেন। সাবিত্রীদেবী খুশি হয়ে বর দিলেন এক কন্যা সন্তানের। সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী সাবিত্রীদেবীর বরে জন্ম বলে কন্যার নাম রাখলেন সাবিত্রী। দেখতে দেখতে সাবিত্রী বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলেন। অশ্বপতি কন্যাকে নিজেই নিজের উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণ করতে বললেন। সাবিত্রী বিভিন্ন স্থান ঘুরে এসে পিতাকে জানালেন যে শাল্ব দেশের রাজা দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানকে তিনি মনে মনে স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন। এবারে রাজা অশ্বপতি দেবর্ষি নারদের শরণাপন্ন হলেন সত্যবানের পরিচয় জানতে, এতে দেবর্ষি বলেন সত্যবান হলেন শাল্বদেশের রাজা দ্যুমৎসেন ও তাঁর স্ত্রী শৈব্যার একমাত্র পুত্র সন্তান ও শাল্বদেশের যুবরাজ, কিন্তু ঘটনাক্রমে দ্যুমৎসেন অন্ধ হয়ে গেলে তাঁর শত্রুরা তাঁকে রাজ্যচ্যুত করেন। এরফলে রাজা সপরিবারে বনবাসী হন এবং বনে এসে দ্যুমৎসেন সস্ত্রীক তপস্যা করতে থাকেন। সত্যবানও তাঁর মাতাপিতার সেবা করে তাপসের জীবনযাপন করতে শুরু করেন। বাল্যকালে সত্যবান ঘোড়া ভালোবাসতেন এবং মাটি দিয়ে অশ্বমূর্তি নির্মাণ করতেন। সে জন্য সত্যবানের অপর নাম চিত্রাশ্ব।রাজা অশ্বপতির এই ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। তখন রাজা তাঁর পরামর্শ জানতে চাইলেন। তখন নারদ জানালেন আরো ভয়ানক কথা, সত্যবান সুদর্শন, সত্যবাদী, দাতা ও ব্রাহ্মণসেবী সত্যি কিন্তু তার আয়ু আর এক বছর। এক বছর পরই তার মৃত্যু ঘটবে। অশ্বপতি সে কথা শুনে কন্যাকে অন্য কোন পাত্রকে বরণ করতে বললেন। কিন্তু সাবিত্রী এতে রাজি হলেন না। সবিত্রী বললেন, ‘মনে মনে যাকে একবার স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছি। তিনিই আমার স্বামী। আমি আর অন্য কাউকে নিজের স্বামী হিসেবে বরণ করতে পারবো না।’ কন্যার যুক্তি মেনে নিলেন অশ্বপতি। সত্যবানের সঙ্গেই সাবিত্রীর বিয়ে হল। সাবিত্রী হিসাব রাখছিলেন, কখন এক বছর পূর্ণ হয়। অবশেষে যখন একবছর পূর্ণ হতে আর মাত্র চার দিন বাকী তখন তিনি উপবাস শুরু করলেন। যে দিন সত্যবানের মৃত্যুর দিন সেদিন সাবিত্রী সত্যবানের সাথে সাথে থাকলেন প্রতি মুহূর্ত। সে দিন সত্যবান বন থেকে কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করতে বনের গভীরে যাচ্ছেন দেখে সাবিত্রীও তাঁর সঙ্গ নিলেন। যদিও সাবিত্রী উপবাসে দুর্বল দেখে সত্যবান নিতে চাইছিলেন না, কিন্তু সাবিত্রী তা মানলেন না। সত্যবানের সাথেই গেলেন। এক মুহূর্তের জন্যও তাকে চোখের আড়াল হতে দিলেন না। কাঠ কাটতে কাটতেই সত্যবান অসুস্থ বোধ করলো। বললো প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। সাবিত্রী সত্যবানকে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে বললেন। সত্যবান তাই করলো। শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। তখন এক ভয়ঙ্কর পুরুষ এসে একহাতে সত্যবানের প্রাণ আর হাতে প্রাণহীন দেহ নিয়ে চলতে শুরু করলে সাবিত্রীও কোন কথা না বলে তাঁর পিছু পিছু চলতে শুরু করলেন। যম সাবিত্রীকে বললেন যে, স্বামীর প্রতি ওঁর যা কর্তব্য তা সম্পন্ন হয়েছে, এখন বাড়ি ফিরে যেতে, কিন্তু সাবিত্রী থামলেন না। যমকে বললেন, স্বামীছাড়া কোন নারীর পক্ষে নির্জন বনে ধর্ম মেনে চলা সম্ভব না। তারপর তিনি যমকে ধর্মকথা শোনাতে লাগলেন। যম তাতে তুষ্ট হয়ে সত্যবানের জীবন ছাড়া আর যে কোনও বর চাইতে বললেন। সাবিত্রী তখন যমের কাছে তাঁর শ্বশুরের অন্ধত্ব দূর করে দিতে বললেন। যম সেই বর দিয়ে ক্লান্ত সাবিত্রীকে ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু কোনকথা না শুনে সাবিত্রী চলতেই থাকলেন। বললেন যে, প্রাণপতির কাছাকাছি থাকলে কোন স্ত্রী কখনো ক্লান্ত হয় না। এছাড়া যম সজ্জন, সুতরাং উনি সাধুসঙ্গ করছেন। যম তখন তুষ্ট হয়ে পতির জীবন ছাড়া আরেকটি বর দিতে চাইলেন। সাবিত্রী এবার বর চাইলেন যেন ওঁর শ্বশুর পুনর্বার তাঁর রাজ্য লাভ করেন। যম সেই বর দিলেন তারপর সাবিত্রীকে বললেন আর পরিশ্রম না করে ফিরে যেতে। সাবিত্রী না ফিরে যমকে সনাতন ধর্মের কথা শোনালেন। যম তাতে প্রীত হয়ে সাবিত্রীকে পতির জীবন ছাড়া অন্য কোনও বর চাইতে বললেন। সাবিত্রী বললেন যে, ওঁর পিতা রাজা অশ্বপতি আজও পুত্রহীন - তাঁর যেন শতপুত্র হয়। যম বর দিয়ে বললেন, অনেক দূরে চলে এসেছো, এবার ফিরে যাও সাবিত্রী। সাবিত্রী বললেন, এটা আমার কাছে দূর নয়, আমি আমার স্বামীর সাথে সাথেই রয়েছি। তারপর যমের প্রশংসা করে বললেন যে, যম সমবুদ্ধিতে প্রজাশাসন করেন বলে তিনি ধর্মরাজও। যম হলেন সজ্জন। নিজের চেয়েও সজ্জনদের উনি বেশি বিশ্বাস করেন। সুতরাং নিজের ক্ষতি নিয়ে তাঁর কোন দুশ্চিন্তা নেই। যম খুশি হয়ে বললেন, সত্যবানের জীবন ছাড়া তিনি আরেকটি বর দিতে চান। সাবিত্রী এবার চাইলেন, ‘আমার গর্ভে যেন সত্যবানের ঔরসে বলশালী শতপুত্র হয়’। যম সাবিত্রীর প্রার্থিত বর দিয়ে বললেন, ধর্মকন্যা, এবার ফিরে যাও। কিন্তু সাবিত্রী আবারো যেতে থাকলেন আর ধর্মকথা শুনাতে থাকলেন। সাবিত্রীর ধর্মসম্মত কথা শুনে যম খুব সন্তুষ্ট হয়ে আর একটা বর দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন সাবিত্রী বলেন যে যমরাজ স্বয়ং ধর্মপ্রাণ ও নিতীপরায়ন তিনিই বর দিয়েছিলেন যে সাবিত্রী সত্যবানের ঔরসে পুত্রলাভের সৌভাগ্য লাভ করবেন এবং সেই সত্য রাখতে যমরাজকে সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে দিতেই হবে। এবারে নিজের বাক্যের সত্য রক্ষা করতে গিয়ে যম সাবিত্রীকে পঞ্চম বর দিতে বাধ্য হন এবং অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ সত্যবানের আত্মা সাবিত্রীকে ফিরিয়ে দিয়ে
সাবিত্রীকে আশীর্বাদ করে বিদায় নেন। এরপর সাবিত্রী সত্যবানের অচেতন শরীরের কাছে এসে, তাঁর মাথা কোলে তুলে নিয়ে বসেন এবং অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ সত্যবানের আত্মা সত্যবানের দেহে স্থাপন করেন। পরে সত্যবানের সংজ্ঞা ফিরে এলে, উভয়েই আশ্রমে ফিরে যান।এইভাবে ধর্ম দিয়ে, সততা দিয়ে সাবিত্রী তাঁর স্বামীর জীবন রক্ষা করলেন। পরদিন আশ্রমে ফিরে ব্রতের পারনা করেন ও সকল আশ্রম বাসীর কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন, তখন সকল আশ্রম বাসীরা সাবিত্রীর জয়গান করতে থাকেন এদিকে যমের আশীর্বাদে দ্যুমৎসেনের চক্ষু ও রাজ্যলাভ এবং অশ্বপতির শতপুত্র ও লাভ হয়। সাবিত্রীর স্বামীর প্রতি এই প্রগাঢ় ভালোবাসা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে সতী নারী হিসেবে।
সঙ্কলকঃ শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...