Friday 26 November 2021

প্রসঙ্গঃ- শনিদেব বা শনিশ্চর

প্রসঙ্গঃ-  শনিদেব বা শনিশ্চর
সঙ্কলক
শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

'শনি' নবগ্রহের একটি অন্যতম গ্রহ, শনি গ্রহকে গ্রহরাজ-ও বলা হয়ে থাকে। শনিদেব সনাতন ধর্ম মতে একজন দেবতা। তিনি উগ্র দেবতা বলে কুখ্যাত।শনিদেবের পরিচয় হল, তিনি হলেন সূর্যদেব ও তার পত্নী ছায়াদেবীর (সূর্যদেবের স্ত্রী ও দেব বিশ্বকর্মার কন্যা দেবী সঙ্ঘামিত্রার ছায়া থেকে সৃষ্ট দেবী ছায়া) পুত্র, এজন্য তাকে ছায়াপুত্র-ও বলা হয়। শনিদেব, মৃত্যু ও ন্যায় বিচারের দেবতা যমদেব বা ধর্মরাজ ও পবিত্র শ্রী যমুনা দেবীর ভ্রাতা।
বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে শনির কাহিনি সম্পর্কে ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। মৎস্য পুরাণে বলা হচ্ছে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার মেয়ে সঙ্ঘামিত্রা সঙ্গে বিয়ে হয় সূর্যদেবের। কিন্তু সূর্যের প্রচণ্ড তাপে প্রায় ঝলসে যান সঞ্জনা। তখন তাঁর নতুন নাম হয় সন্ধ্যা। নিজের এমন দূরবস্থায় স্বামীর প্রতি সমস্ত ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সূর্যের থেকে দূরে পালাতে চান তিনি। কিন্তু কী ভাবে? তখন সন্ধ্যা নিজেরই একটি প্রতিকৃতি সৃষ্টি করেন। বলা যেতে পারে এটিই বিশ্বের প্রথম ক্লোন। তাঁর নাম দেন ছায়া। ছায়াকে স্বামীর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে সন্ধ্যা পিতার ঘরে ফিরে যান। এ ভাবে যে তাঁর স্ত্রী বদল হয়ে গেল তা খেয়ালই করেন না সূর্যদেব।
পরবর্তীকালে সূর্য ও ছায়ার সন্তান হিসেবে জন্ম নেন শনি। মেয়ে তাঁর কাছে, এদিকে সূর্যের সন্তান-জন্মের খবর পেয়ে বিশ্বকর্মা ধন্দে পড়ে যান। সন্ধ্যার কাছে ছুটে গিয়ে সব জানতে চান। সব শুনে বিশ্বকর্মা সন্ধ্যাকে সেই মুহূর্তেই পতিগৃহে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। ক্ষুব্ধ সন্ধ্যা ফিরে গিয়ে ছায়াকে নিঃশেষ করে নিজে ফের সূর্যের স্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এ ঘটনাও সূর্যের নজর এড়িয়ে যায়।
এর পর শনির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে শুরু করেন সন্ধ্যা। শনিকে সূর্যের থেকে দূরে সরাতে অনবরত স্বামীর কান ভাঙাতে থাকেন সন্ধ্যা। এভাবে মায়ের স্নেহ এবং বাবার ভালোবাসা না পেয়ে ক্রুদ্ধ, বিরক্ত, অলস হয়ে উঠতে থাকেন শনি। কোনও কিছুই তাঁর ভালো লাগে না।
পরবর্তীকালে সূর্যের ঔরসে সন্ধ্যার গর্ভে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখা হয় যম ও মেয়ের নাম যমুনা। ক্রমে ছেলে-মেয়েরা বড় হলে তাঁদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন সূর্য। যমকে দেওয়া হয় ধর্মরাজের দায়িত্ব। পৃথিবীর বুকে ধর্মরক্ষার দায়িত্ব তাঁর। যমুনা পবিত্র নদীর রূপ নিয়ে সব পাপ-তাপ ধুয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পান।
সন্ধ্যার ক্রমাগত কান ভাঙানোর ফলে বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শনিকে কোনও দায়িত্বই দেন না সূর্য। এ ভাবে বঞ্চিত, অসহায় শনি ভাই-বোনের থেকে দূরে সরে গিয়ে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। একদিন শোক ও রাগে পাগল হয়ে সন্ধ্যাকে লাথি মারেন তিনি। সেই রাগে শনিকে খোঁড়া হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন সন্ধ্যা। মা-কে লাথি মারার জন্য শনির ওপর সূর্য ক্রুদ্ধ হলেও বেশি অবাক হন সন্ধ্যার ভূমিকায়। একজন মা কী করে তাঁর সন্তানকে এমন অভিশাপ দিতে পারেন! সন্ধ্যার কাছে সব কথা জানতে চান তিনি। সূর্যের জেরায় ভেঙে পড়ে অবশেষে তাঁকে সব জানাতে বাধ্য হন সন্ধ্যা। শনির ওপর এতদিন এত অন্যায় হয়েছে বুঝতে পেরে নিজের ভুল স্বীকার করেন সূর্য। শনিকে সৌরমণ্ডলে স্থান দেন তিনি। কর্মফলের দেবতা হিসেবে শনিকে উন্নীত করা হয়। এ জন্যই কেউ কোনও অপকর্ম করলে শনির নজর এড়ায় না এবং শনির হাতে তার শাস্তি নিশ্চিত।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে একদিন শনি দেবের স্ত্রী দেবী ধামিনী সুন্দর বেশভূষা নিয়ে তার কাছে এসে কামতৃপ্তি প্রার্থনার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি সেদিকে খেয়ালই করেন না। যার ফলে অতৃপ্তকাম পত্নী শনিকে অভিশাপ দিলেন, ‘আমার দিকে একবারও তুমি ফিরেও চাইলে না। ঠিক আছে এরপর থেকে তুমি যার দিকে চাইবে, সে-ই ভস্ম হয়ে যাবে’। তবে অনেকের মত ঘটনাটি মঙ্গলদেবের চক্রান্তে হয়েছিল।
আরো একটি কাহিনী
শনি দেবের জন্ম নিয়ে পুরাণে অনেক কিছু বর্ণনা রয়েছে। শোনা যায়, সূর্যদেবের স্ত্রী সঙ্ঘামিত্রা দেবী, তাঁর স্বামীর প্রখরতা ও তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীর থেকে ছায়ার সৃষ্টি করেন। সেই ছায়া তিনি নিজের জায়গায় বসিয়ে রেখে তপস্যায় যান। সেই সময় ছায়ার সঙ্গে সূর্যদেবের মিলনের ফলে শনির জন্ম হয়।কিন্তু তাঁর গায়ের রং হয় কুচকুচে কালো, যা নিয়ে সূর্যদেব দেবী ছায়াকে তাঁর পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। মায়ের এই অপমান সহ্য করতে পারতেন না শনি দেব। একদিন বদলা নিতে অগ্নিদৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকান তিনি। যার ফলস্বরূপ সূর্য পুড়ে কালো হয়ে যান।সেই সময় শিব এসে রক্ষা করেন সূর্যকে। শিবই সূর্যকে সমস্ত সত্যি জানান এবং কোনও অন্যায় দেখলে তার বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে যান শনিকে। সেই থেকেই বিচারের দেবতা হিসাবে পরিচিত শনি দেব।
শনিদেবকে কোনও অপশক্তি মনে করলে ভুল করা হবে। তিনি ইচ্ছা করে কোনসময় কারোকে বিপদে ফেলেন না। গ্রহ হিসেবে শনি নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেন। এই গুণগুলি থেকে বিচ্যুত হলে তিনি কুপিত হন। মানুষের যাবতীয় কর্ম— ভাল-মন্দ কিছুকেই শনিদেব লক্ষ করেন। দুষ্কর্মের জন্য তিনি রুষ্ট হন। কতগুলি সদগুণ শনি যেমন নিয়ন্ত্রণ করেন,তেমনই দুর্ঘটনা, লোভ, নেশা বা আসক্তি, অপরাধ প্রবণতাকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। শনিদেব কিন্তু পরম শিবভক্ত। কারো প্রতি শনি কুপিত হলে তিনি আগে থেকেই তার আভাস পেয়ে যাবেন অন্তত আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার উল্লেখ আছে। আমরা প্রায়ই শুনি শনির দশা চলেছে। একথা অপ্রিয় হলেও সত্যি আমাদের ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণে শনিদেব এক অতি পরিচিত দেবতা উনাকে নিয়ে হাজারো কাহিনীর পরিচয় আমরা পাই। তার মধ্যে একটি অতি জনপ্রিয় কাহিনী হল নল-দময়ন্তীর। শনির প্রকোপে রাজা নলের কী দশা হয়েছিল, তা আমরা সকলেই অবগত।
এবার আপনারা বলুন তো, আপনারা কি ভাবেন, সত্যিই কি শনি এক ভয়ানক দেবতা?

May be an image of sky
Like
Comment

Friday 3 September 2021

প্রসঙ্গঃ- শ্রীমতি রাধারাণী

 শ্রীমতি রাধারাণী

সঙ্কলকঃ শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী


আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে এক প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খায়, শ্রী কৃষ্ণ নামের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত যে শ্রী রাধার নাম সে রাধা আসলে কে? ...সে প্রশ্নের উত্তর খুজতে খুজতে এক বিশাল সাগরে ডুব মারার অবস্থা হয়েছে, আমি নিজেও চেষ্টা করছি সেই প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানের । এই প্রচেষ্টায় যে টুকু প্রাপ্ত জ্ঞান তা আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরার যথাসাধ্য প্রয়াস করে যাবো... আগেই বলেছি এ এক বিশাল ব্যাপার  তাই  আমি শুরু করার আগে পরমেশ্বরের কাছে আশীর্বাদ কামনা করে নিচ্ছি এই যে তিনি যেন আমার সাথে এই কাজে সহায়তা করে থাকেন...।

ঋষি বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর রচিত 'কৃষ্ণচরিত্র' প্রবন্ধে যেভাবে রাধাকে বর্ণণা করেছেন তা কিছুটা এইরূপ...

"ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আর জয়দেবের কাব্য ভিন্ন কোন প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নেই। ভাগবতের এই রাসপঞ্চাধ্যায়ের মধ্যে 'রাধা' নাম কোথাও পাওয়া যায় না। বৈষ্ণবাচার্যদিগের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাঁহারা টীকা টিপ্পনীর ভিতর পুনঃপুনঃ রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়াছেন কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নাই। গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈর্ষার প্রমাণ স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে তাহারা পদচিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিলেন যে, কোন এক গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রম মাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকে লইয়া অন্তর্হিত হইলেন এমন কথা নাই এবং রাধার নামগন্ধও নাই।

রাসপঞ্চাধ্যায়ে কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নেই। ভাগবতে কেন, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নেই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা! রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণ নাম নেই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নেই বা মূর্তি নেই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন, তবে এ 'রাধা' আসিলেন কোথা হইতে?"

শুধু তিনিই নন, 'বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়' এর লেখক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক,ডঃ শশীভূষন দাশগুপ্ত, ডঃ নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখ ব্যক্তিরাও শ্রীমতি রাধার চরিত্রকে ভ্রান্ত এবং মধ্যযুগ পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদী সম্প্রদায় কর্তৃক নতুন করে আবিষ্কৃত এক পৃথক সত্বা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বেদে রাধার বর্ণনা ????

আজকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার আগে আমি কিছু আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক কিন্তু 'স্পর্শকাতর' তাই আমি বলে রাখছি আমি কিন্তু কারো ভাব বা বিস্বাসে আঘাত দেওয়ার পক্ষপাতী নই। শ্রীভগবান গীতায় বলছেন- যে "যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম" যে আমাকে যে ভাবে ভজনা করে, আমিও তাকে সেইভাবে ভজনা করি। কথা হল ভক্তিতে ভাব থাকা চাই, ভালোবাসা দ্বারা ভক্তি চাই। আমার কাছে তেমন কোন তথ্য না থাকায় বহুলাংশে আমি ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন ভাষায় উপলব্ধ বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে আমার এই পরিবেশন অতএব অজ্ঞানবশতঃ ভুল ভ্রান্তির সম্ভাবনা প্রবল শুধুমাত্র নিজের কৌতূহল ও পাঠকদের অনুপ্রেরনা আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।  

আমি আজ আমাদের আদিগ্রন্থ 'বেদ' এ দেখবো কি আছে? কেননা কিছু ব্যাক্তিরা দাবী করছেন যে বেদে রাধার বর্ণনা আছে। সত্যি কি তাই???

ব্যাকরণের দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে পাই , যিনি আরাধনা করেন, তাকে এক কথায় তাকেই বলা হয় রাধা। বৈদিক শব্দ কোষেও রাধ্ শব্দের অর্থ আরাধনা করা এই অর্থে সকল ভক্ত যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভজনা বা আরাধনা করেন, তারাই রাধা তাই পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার আত্মসমর্পণই কৃষ্ণের প্রতি রাধার আত্মসমর্পনের রূপ পেয়েছে। আবার যেমন বিরহের প্রচণ্ড ব্যাকুলতা ছাড়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা সম্ভব নয়, তাই রাধা রূপী জীবাত্মাও, ভক্তের কাছে নারী রূপী রাধায় পরিণত হয়ে উঠেছে।

এবার দেখে নেবো কিছু সংখ্যক ব্যাক্তিরা যারা দাবী করে চলেছেন যে রাধার বর্ণনা বেদেও আছে, তাঁদের যুক্তি কতটুকু গ্রহন যোগ্য।

য়দিন্দ্র চিত্রম ইহ নাস্তি ত্বাদাতমন্দ্রিবঃ।

রাধস্তন্নো বিদপূস উভয়া হস্ত্য আভব”।।

এ মন্ত্রে রাধস্তন্নো যে শব্দটি রয়েছে তা কিন্তু সেই 'রাধা’ নয় এখানে রাধ শব্দের অর্থ হলো আরাধ্য শক্তি। এই মন্ত্রটির যথার্থ ভাবার্থ অনুধাবন করলে আমরা পাই..।।

হে (ইন্দ্র) ইন্দ্র পরমাত্মন! আপনি (য়ৎ) এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে যাহা কিছু (চিত্র) নানা প্রকার চিত্র বিচিত্র রূপে ( আদ্রিবঃ) বিশাল সমুদ্র বা জলাদির ধারায় পর্বত সদৃশ্য বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্বামী কর্তা বিধাতা হন। আপনি কৃপয়া (মে) আমাদেরকে (ত্বাদাতম) যাহা কিছু প্রদান করেন তাহারা বিস্তৃতভাবে (তৎ) এ (রাধঃ) আরাধ্য শক্তি (বিদৎ বসো) বিদ্বান যোগী তপস্বী সাধক জনদের মধ্যে সাধনার দ্বারা লব্ধ ওই শক্তি (নঃ) আমাদের জন্য ( উভয়া হস্ত ভব) উভয় হাতে উন্মুক্তভাবে প্রদান করুন।

বেদের অপর একটি শ্লোকে আছে যে

ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে।

পিবা ত্বাস্য গিবর্ণঃ।।

এখানে " রাধানাং পতে" শব্দটির অর্থ শ্রীকৃষ্ণ নয়। এখানে এই শব্দ দুটির অর্থ হল সৃষ্টির জ্ঞান-ধন-প্রজা ঐশ্বর্য ইন্দ্রিয় ইত্যাদির মালিক।

মন্ত্রটির ভাবার্থটি এইপ্রকার

হে মনুষ্য! ( রাধানাম পতে) এই অনন্ত ব্রহ্মান্ডের মধ্য সৃষ্টির জ্ঞান -ধন- প্রজা ঐশ্বর্য ইন্দ্রিয় আদির মালিক যিনি ( ইদং) বিশ্বজগৎকে নিজের শক্তি বল পরাক্রমের দ্বারা (সুতং) নিখুঁত ভাবে সৃজন করে, তাহার সমস্ত জ্ঞান প্রাপ্তির উপাই (গিবর্ণ) দেব বাণী আদির প্রদান করে (তু) তোমরা সকলে তাহাকে ভালোভাবে গ্রহন করে (আপিব) ঈশ্বরের জ্ঞান কে পান করো।

আরেকটি শ্লোকে পাই

অভীষুণঃ সখীনামবিতা জরিতৃণাম।

শতং ভবাস্যুতয়ে।।

এখানে কিন্তু সখীনাম শব্দের অর্থ রাধা নয়।যা অনেকে দাবী করে থাকেন ।এর আসল অর্থ হচ্ছে সখার চেয়েও মহান সখা অর্থাৎ পরমেশ্বর।

মন্ত্রটির অর্থ হলো

হে পরমেশ্বর! (নঃ) আপনি আমাদের একমাত্র (অভি) চারিদিক থেকেই (সু আবিতা) সুরক্ষা করে থাকেন। সেই জন্য সকলে আপনারই (সখীনাম) সখার চেয়েও সখা যুক্ত মহান সখারূপে আপনি সর্বদাই (জরিতৃণাম) স্তুতি প্রার্থনা উপাসনা কারীদের প্রতি আপনি (শতম) শত সহস্র হাজার হাজার উপায়ে আমাদেরকে (উতয়ে) সুরক্ষা করে নিরন্তরই (ভবাসি) নিজের স্বরূপেই বিদ্বমান থাকেন।

আরেক জায়গায় আছে

ইন্দ্রস্য সোমরাধসে পুনানো হাদিচোদয়।

দেবনং য়োণিমাসদম।।

এই মন্ত্রে "রাধসে" শব্দটি আরাধনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোন

বিশিষ্ট ব্যক্তিবাচক নাম হিসেবে ব্যবহার হয়নি।

মন্ত্রটির অর্থ খুজলেই তা পাওয়া যায়।

হে মনুষ্য (রাধসে) পরমেশ্বরের সাধন ভজন আরাধনার জন্য প্রথমে হৃদয় সহকারে (দেবানং) পঞ্চ ভৌতিক শরীরের সমস্ত দিব্য গুন কর্ম স্বভাবকে নিয়ে জড় চেতন তত্ত্বের জ্ঞান লাভ করে (অসদম) মূল তত্ত্ব জ্ঞানের শরীর বিজ্ঞান -আত্ম বিজ্ঞান এবং পরমাত্মা বিজ্ঞানের (য়োনীং) মূল কারনকে (চোদয়) কেবলমাত্র ইশ্বরের দিকেই নিরন্তর প্রেরন করতে থাকে। কেননা অনন্ত সৃষ্টির মূল কারন বা বীজ পরমাত্মাই।

অপর একটি শ্লোকে আছে...

দুক্ষ্যং সুদানং তবিষীভিরাবৃতং গিরিং ন পুরুভোজসম।

ক্ষমন্তং বাজং শতিনং সহস্রিনং মক্ষু গোমন্তমীমহে।।

যার আসল অর্থ এই রূপ

হে সাধক মনুষ্য! (দুক্ষং) দিব্যগুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (সুদানং) উত্তম দাতা (তবিষীভি) নানা প্রকার বল শক্তি দ্বারা (আবৃতঃ) চতুর্দিকে আবৃত অবস্থায় (শতিনং) শত ( সহস্রিনং) হাজার হাজার (গোমন্তা) গো বংশে ইন্দ্রিয় বৃত্তি সমূহ তথা বাণীর ধারা দিয়ে (বাজং) বল বীর্য পরাক্রমে সর্বদাই আমরা (ঈমহে) প্রাপ্তির জন্য শুভ কামনা করে থাকি।

এখানে "গোমন্ত" শব্দের সাথে রাধা নামের মিল খুঁজে পেয়েছেন কিছু সংখ্যক ব্যাক্তি, কিন্তু আসলে শব্দের অর্থ হলো গো বংশে ইন্দ্রিয় বৃত্তিসমূহ।

 আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে লেখা মহাভারত সেখানেও রাধার কোন উল্লেখ নেই অতএব গীতাতেও রাধার কথা থাকা সম্ভব নয়। এমন কি বিষ্ণুপুরানে ও রাধার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে রাধার উল্লেখ আছে, এছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলী, যা রাধার, কৃষ্ণের প্রতি প্রেম বিরহ নিয়ে লেখা একাধিক কবির পদ্য এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, এইসবে রাধার উল্লেখ আছে। এইসকল দিক দিয়ে চিন্তা করলে রাধার বিষয় নিয়ে একটি সংশয় থেকেই যায়। আপনারা লক্ষ্য করলে দেখে থাকবেন যে প্রাচীন হাজার বছরের পুরানো যতগুলো মন্দির আছে সেই সব কোন মন্দিরেই কৃষ্ণের রাধাকে দেখা যায় না। কারণ রাধার জন্মই হয়েছে মধ্যযুগের কবিদের কল্পনায়! রাধাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহিত্যরস সৃষ্টির খাতিরে। সেই জন্যে আমরা রাধাকে ব্যাপকভাবে দেখতে পাই সাহিত্য জগতে। বৈষ্ণব কাব্যে কবি জয়দেব, কবি চণ্ডীদাস, কবি বিদ্যাপতি, কবি জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, কবি বলরাম দাস প্রভৃতি কবিদের রচনার ছত্রে ছত্রে রাধা আছেন। নানা ভাব মাধুর্যের লীলা রসে সদাই রাধা বিচরণশীল।

রাধা আসলেই কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দার্শনিকরা দার্শনিকতত্ত্ব রূপে যা কিনা মাত্র কয়েকশো বছরের প্রাচীন শ্রীকৃষ্ণের লীলা শক্তির যে প্রধান তিন ভাগের স্বরূপ শক্তি, জীবশক্তি ও মায়া শক্তির বর্ণণা করেছেন সেই তিনটি মূখ্য উপভাগ রয়েছে (অর্থাৎ সৎ, চিৎ ও আনন্দ) সেই উপভাগের মধ্যে আনন্দ তত্ত্বটি বা হ্লাদিনী তত্ত্বের মানবী রূপ হিসেবে কল্পনা করেছেন রাধাকে। অর্থাৎ রাধা হলেন সম্পূর্ণত গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এবং গৌড়ীয় দার্শনিকদের আনন্দ বা হ্লাদিনী নামক তত্ত্বের কাল্পনিক মানবিক চরিত্র মাত্র! রাধার কোন ঐতিহাসিকতা বা বাস্তব অস্তিত্ব কোন কালেও ছিল না।

পরিশেষে এতটুকুই বলবো যে

শ্রী কথার অর্থ শক্তি অর্থাৎ রাধা। কৃষ্ণ যদি শব্দ হন তাহলে রাধা তার অর্থ, কৃষ্ণ যদি বাঁশী হন তাহলে রাধা তার সুর, কৃষ্ণ সমুদ্র হলে রাধা তার তরঙ্গ, কৃষ্ণ যদি ফুল হন রাধা তার সুগন্ধি। আসলে রাধা হলেন শ্রী কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। তাঁরা একে অন্যের থেকে পৃথক নন। ভক্তের জন্যে তাঁরা পৃথক রূপ ধারন করেন ও পৃথক পৃথক ভাবে লীলা করে থাকেন। রাধা এক আধ্যাত্মিক রূপ যেখানে দ্বৈত ও অদ্বৈতের মিলন। রাধা এক সম্পূর্ণ কালের উদ্গম যা শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়।শ্রীকৃষ্ণের জীবনে রাধা প্রেমঘন মূর্তিরূপে বিরাজিত। কৃষ্ণ প্রেমের পরিমান কেউ মাপতে পারেনি। সেই প্রেমের আধার শিলা রাধাই স্থাপন করেছিলেন। সমগ্র ব্রহ্মান্ডের আত্মা হলেন গিয়ে রাধা আর শ্রী কৃষ্ণের আত্মা হলেন গিয়ে রাধা। আত্মাকে কি কেউ কখনো দেখতে পেরেছে? না তা সম্ভব নয়। সেই ভাবে রাধা ও চিরকাল ভক্ত-মানসে রহস্য হয়ে থাকবেন।

সমাপ্ত।

হরি ওম তৎ সৎ। শ্রী রামকৃষ্ণায় অর্পনোমস্তু।।


Saturday 14 August 2021

তিলভান্ডেশ্বর শিব

 তিলভান্ডেশ্বর শিব

সঙ্কলকঃ- শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী


আজ আপনাদের কে শোনাবো তিলভান্ডেশ্বর শিবের বর্ণনা । আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন, যারা জানেন না তাদের জন্যে আমার এই সামান্য প্রয়াস। মহাদেবের চরণে শতকোটি প্রণাম জানিয়ে শুরু করছি। 

  আমরা সকলেই জানি বারাণসীর প্রতিটি স্থানে মিশে আছে শিবের অস্তিত্ব, কারণ সে যে শিবের আপন নগর। এখানে ভৈরবের মন্দির, কাশী বিশ্বনাথের মন্দির ছাড়াও আরেকটি বিখ্যাত মন্দির আছে যা আমরা তিলভান্ডেশ্বর মন্দির হিসেবে জানি। কথিত এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ আপনা আপনি প্রকট হয়েছিলেন।  কিংবদন্তী অনুসারে প্রত্যেক মকর সংক্রান্তিতে এই শিবলিঙ্গ এক তিল করে আকারে বৃদ্ধি হয়। সত্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই শিবলিঙ্গ প্রত্যেক বছর ধরে এক তিল করে বৃদ্ধি হয়ে আসছেন। শিবপুরাণেও এই শিবলিঙ্গের বর্ণনা আছে।  বারাণসীর এই মন্দিরটি আনুমানিক ২৫০০ বছর আগে (১৮শ শতাব্দীতে) তৈরী করা হয়।  বারাণসীতে  ভেলুপুর বাঙ্গালী টোলাতে এই মন্দিরটি অবস্থিত। 

            

অলৌকিক বিষয় হল এই শিবলিঙ্গ প্রতি বছর এক তিল করে বৃদ্ধি পাচ্ছেন। সেই জন্যে উনার নাম হয় তিলভান্ডেশ্বর। আবার অন্যমতে যেখানে এই মন্দিরটি আছে  সেই জায়গায় একসময় তিলচাষ করা হতো, তিলচাষের জমি ছিলো। একদিন তিলচাষীরা সেই জমিতে এই শিবলিঙ্গকে মাটি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেন এবং সেই থেকে প্রতি বছর এই শিবলিঙ্গ এক তিল পরিমান বৃদ্ধিলাভ করতে থাকেন। সেই অঞ্চলের মানূষেরা এই শিবলিঙ্গের মাথায় তিল অর্পন করে পূজা করতো সেই থেকেও এই শিবের নাম হয় তিলভান্ডেশ্বর। সেই শিবলিঙ্গ প্রতিবছর বৃদ্ধি হয়ে আজ এক বিশাল শিবলিঙ্গে পরিণত হয়েছেন।বর্তমানে এই শিবলিঙ্গের উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফিট আর ব্যাস প্রায় তিন ফিট। এখানে শিব সাক্ষাৎ বিরাজমান। 

 এই শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। মোঘল আমলে এই মন্দিরের উপর অনেক বার আক্রমণ করা হয়েছিল কিন্তু প্রতিবারেই তা ধ্বংস করতে বিফল হয়, অলৌকিক কারনে প্রতিবারই মোঘল সেনারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ শাসন কালেও এই মন্দিরের উপর ব্রিটিশেরা চড়াও হয়েছিল। কথিত আছে একবার এই শিবলিঙ্গকে ব্রিটিশেরা পরীক্ষার জন্যে দড়ি দিয়ে বেধে রেখে ছিলেন কিন্তু আশ্চর্য ভাবে পরদিন্ যখন মন্দির খোলা হয় তখন দড়ি গুলো ছেঁড়া অবস্থায় পাওয়া যায়।               

         এই মন্দিরে শিবলিঙ্গের উপর ফুল, বেলপাতা জল ছাড়াও তিল অর্পন করা হয়। তিল অর্পন করা হয় বলে এই মন্দিরে পূজা দিলে  শনির প্রকোপ থেকেও মুক্তি লাভ হয় বলে বিশ্বাস। এই শিবলিঙ্গের আরাধনার ফলে জীবনের তিলমাত্র পাপ অবশিষ্ট থাকে না।

হর হর মহাদেব

  • ছবি সৌজন্যেঃ গুগোল 
  • Picture curtsy: Google image


Thursday 12 August 2021

নাগপঞ্চমী

 প্রসঙ্গঃ নাগপঞ্চমী

আগামীকাল শ্রীশ্রীনাগপঞ্চমী, আসুন জেনে নেই এই সম্বন্ধে কিছু তথ্য
শ্রাবণ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয় নাগ পঞ্চমী। এই উৎসব নাগ দেবতাকে উৎসর্গীকৃত। এদিন নাগ দেবতার পুজো করা হয় ও উপোস রাখা হয়। ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী নাগ পঞ্চমীর দিনে নাগ দেবতার আরাধনা করলে একাধিক শুভ ফল লাভ করা যায়। বিশেষতঃ যাদের জন্মছকে কালসর্প যোগ আছে তাঁরা এই দিনে অষ্টনাগের পূজা দুধ কলা দ্বারা করলে বিশেষ লাভবান হতে পারেন, জীবনের দুঃখ কষ্ট দূর হয়। অনন্ত, বাসুকি, তক্ষক, কর্কোটক, পদ্ম, মহপদ্ম, শঙ্খপাল ও কুলিক নামক আটটি নাগকে এই পুজোর দেবতা মনে করা হয়। পুরাণ মতে ও পাওয়া যায় , নাগ লোক বা পাতাল থেকে সমস্ত সর্পকুল এইদিন মর্তের মানুষদের আশীর্বাদ করে থাকেন। জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি, অভাব অনটন ঘোচাতে সাপেদের এই আশীর্বাদ অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ বলে অনেকের ধারণা। এইদিনে নাগদেবতার মূর্তির সামনে রাখা হয় দুধ, চন্দন, হলুদ ও সিঁদুর। মূর্তির সামনে জ্বালানো হয় কর্পূরের প্রদীপ। তবে ধূনা জ্বালানো উচিত নয়। পাঠ করা হয় নাগপঞ্চমী ব্রতকথা নাগ পঞ্চমীর দিন পুজোর সময় শিবের পঞ্চামৃত পান করা কার্যকরী ফল দেয় বলে অনেকের মত। এতে বহু বাধা বাপত্তি , রোগ দুর্ভোগ কেটে যায়।
গরুড় পুরাণ’ মতে, ব্রহ্মার পুত্র মহামুনি কাশ্যপের তৃতীয় স্ত্রী কদ্রু ছিলেন নাগ বংশের কন্যা। তিনিই নাগকুলের মাতা। কাশ্যপের আরেক স্ত্রী বিনতা জন্ম দেন গরুড়ের। বিনতাকে সহ্য করতে পারতেন না কদ্রু । ছোট থেকেই গরুড় মায়ের কষ্ট দেখে প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি সর্পকুল ধ্বংস করবেন। কিন্তু পরে তা থেকে বিরত হন। কিন্তু সর্পকুলের সঙ্গে গরুড়ের শত্রুতা থেকেই যায়। তবে এই পুণ্য জন্মের কারণে নাগকুলও পুজো পেতে থাকে।
মহাভারত থেকে জানা যায়, কুরু বংশীয় রাজা পরিক্ষিৎ তক্ষক নাগের আঘাতে মারা গেলে তাঁর পুত্র জন্মেজয় পৃথিবী সর্পশূন্য করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি এক সর্পযজ্ঞ শুরু করেন, যেখানে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কোটি কোটি সাপ যজ্ঞানলে পড়ে মারা যেতে থাকে। এই সময়ে জরৎকারু মুনির পুত্র আস্তিক এই নিষ্ঠুর যজ্ঞ বন্ধ করতে জন্মেজয়ের কাছে পৌঁছান এবং তাঁরই হস্তক্ষেপে জন্মেজয় এই ভয়ঙ্কর কর্ম থেকে নিরস্ত হন। লৌকিক বিশ্বাস মতে, জরৎকারুর স্ত্রী মা মনসা। যে দিনটিতে সর্পযজ্ঞ বন্ধ হয়, সেই দিনটি ছিল শ্রাবণের শুক্লপঞ্চমী। সেই থেকেই এই পূজার প্রচলন।
সঙ্কলক
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

Saturday 17 July 2021

বদ্রীনাথ মন্দির

বদ্রীনাথ মন্দির

সঙ্কলকঃ-শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

বিখ্যাত বদ্রীনাথ মন্দিরটি উত্তর ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলায় গাড়ওয়াল পার্বত্য অঞ্চলে অলকানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত।  প্রাচীন বৈদিক ধর্মগ্রন্থগুলিতে এই মন্দিরের প্রধান দেবতা বদ্রীনাথের উল্লেখ আছে, যা থেকে বোঝা যায়। যে বৈদিক যুগে এই মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল।গর্ভগৃহে  বদ্রীনারায়ণের  যে মূর্ত্তি টি আছে তা প্রায় ৩.৩ফুট উচ্চতার, কষ্টি পাথরের বিগ্রহ। একটি বদ্রী গাছের তলায় সোনার চাঁদোয়ার নীচে রাখা।বদ্রীনারায়ণের মূর্তির উপরের দুই হাতে শঙ্খ ও চক্র আর নীচের দুই হাত যোগ মুদ্রায় । শোনা যায় ৯ম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য প্রথম বদ্রীনাথকে একটি তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। ৮১৪ থেকে ৮২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছর তিনি এই অঞ্চলে ছিলেন। কথিত আছে বদ্রীনাথের মুর্তিটিকে অসুরের হাত থেকে রক্ষার জন্যে মন্দিরের পুরোহিতরা অলকানন্দার জলের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু পরে সেই জায়গাটী ভুলে যাওয়ায় মুর্তি উদ্ধার সম্ভব হয় নি, যোগাবলে শঙ্করাচার্য এই  বদ্রীনাথের মূর্তিটির সন্ধান পান এবং  তিনিই অলকানন্দা নদী থেকে উদ্ধার করে তপ্তকুণ্ড উষ্ণ প্রস্রবণের কাছে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। পুরাণ অনুসারে, এক ঋষি লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর পাদসেবা করতে দেখেন, এবং  তাই দেখে তিনি বিষ্ণুকে তিরস্কার করেছিলেন। সেই জন্য বিষ্ণু বদ্রীনাথে এসে দীর্ঘ সময় পদ্মাসনে বসে তপস্যায় রত ছিলেন। তখন হিমালয়ের একটি অঞ্চলে মাংসভুক সন্ন্যাসী ও অসাধু লোকজনেরা বাস করত, কিন্তু এই স্থানটি তার থেকে দূরে ছিল বলে বিষ্ণু ধ্যানের জন্য এই স্থানটিকেই ঠিক করেন। ধ্যানের সময় বিষ্ণু এখানকার দারুণ শীত সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তার স্ত্রী লক্ষ্মী একটি বদ্রী গাছের আকারে তাকে রক্ষা করেন। লক্ষ্মীর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু এই অঞ্চলের নাম দেন বদরিকাশ্রম। আবার  বিষ্ণুপুরাণে বদ্রীনাথের উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি গল্প আছে। সেখানে আছে , ধর্মের দুই পুত্র ছিল – নর ও নারায়ণ, এঁরা হিমালয়ে পর্বতরূপ ধারণ করেছিলেন। তারা ধর্মপ্রচারে জন্য এই স্থানকে নির্বাচিত করেন এবং হিমালয়ের বিভিন্ন  বৃহৎ উপত্যকাগুলিকে বিবাহ করেছিলেন। আশ্রম স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গার অনুসন্ধানে এসে তারা পঞ্চবদ্রীর অন্যান্য চার বদ্রীর সন্ধান পান।  এগুলি হল বৃধাবদ্রী, যোগবদ্রী, ধ্যানবদ্রী ও ভবিষবদ্রী। অবশেষে তারা অলকানন্দা নদী পেরিয়ে উষ্ণ ও শীতল প্রস্রবনের সন্ধান পান এবং এই স্থানটির নামকরণ করেন বদ্রীবিশাল। ভাগবত পুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও মহাভারত-এর মতো প্রাচীন গ্রন্থেও কিন্তু বদ্রীনাথ মন্দিরের উল্লেখ আছে, ভাগবত পুরাণ অনুসারে, বদরিকাশ্রমে ভগবান বিষ্ণু নর ও নারায়ণ ঋষি রূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন এবং সকল জীবের কল্যাণের জন্য তাঁরা এখানে স্মরণাতীত কাল থেকে এখানে  তপস্যা করেন। স্কন্দপুরাণ-র বলা হয়েছে, স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল লোকে অনেক পবিত্র তীর্থ আছে। কিন্তু বদ্রীনাথের মতো পবিত্র তীর্থ কোথাও নেই। পদ্মপুরাণ-এ বদ্রীনাথের আশেপাশের এলাকাটিকে আধ্যাত্মিক সম্পদে পরিপূর্ণ বলে উল্লেখ আছে।  মহাভারতে পাওয়া যায় যে  অন্যান্য তীর্থে মোক্ষ অর্জন করতে হলে ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয়। কিন্তু বদ্রীনাথের কাছে এলেই ভক্তের মোক্ষ লাভ হয়ে যায়।



জানেন কি? বদ্রীনাথে শঙ্খ বাজানো নিষিদ্ধ!!!! কেন?

পুরাকালে হিমালয়ের পাদদেশে ঋষি-মুনিদের উপর অসুরদের অত্যাচার খুব বৃদ্ধি পায়। প্রায়ই অসুরেরা ঋষি মুনিদের আক্রমন করে তাঁদের আশ্রম লন্ডভন্ড করে বির্বিচারে হত্যা করতে লাগলো। শত শত ঋষি মুনিদের বন্দি করে দাস বানিয়ে রাখতো। তখন সকল ঋষি মুনিরা অগস্ত্য মুনির শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অগস্ত্য মুনি তখন অসুরদের নিধনের জন্যে দেবী দুর্গা কে আহ্বান করেন। অগস্ত্যমুনির প্রার্থনায় দেবী কুষ্মান্ডা রূপে আবির্ভাব হয়ে অসুর নিধন শুরু করেন, একে একে সকল অসুর দেবীর হাতে পরাজিত ও নিহত হয় কিন্তু আতাপি ও বাতাপি নামক দুই অসুর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আতাপি অলকানন্দা নদীতে গিয়ে আত্মগোপন করে আর বাতাপি বদ্রীনাথ ধামে গিয়ে শঙ্খের ভিতরে লুকিয়ে পরে সেই থেকে বদ্রীনাথ ধামে শঙ্খ বাজানো নিষিদ্ধ হয় এবং সেই প্রথা আজও চলে আসছে। এই এক মাত্র মন্দির যেখানে শঙ্খ বাজানো যায় না।

সমাপ্ত

চিত্র সৌজন্যেঃ- গুগোল চিত্র


Wednesday 14 July 2021

জয় মা বিপদতারিণী বা বিপদনাশিনী!!

 আসুন জেনে নেই কে এই দেবী?


যিনি সমগ্র বিপদ থেকে রক্ষা করেন বা যিনি বিপদ সমূহ নাশ করেন তিনিই বিপদতারিনী। যিনি দুর্গা তিনিই বিপদতারিনী, তিনিই আবার পুরাণে কৌশিকীদেবী নামে খ্যাতা, আবার তিনিই জয়দুর্গা। করি।তিনি দেবী সঙ্কটনাশিনী এবং দেবী দুর্গার ১০৮ রূপের এক অন্যতম, ভক্তেরা মূলত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এই দেবীর পূজা করেন। বিশ্বাস অনুযায়ী, বিপত্তারিণী ব্রত পালন করলে সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় এবং সমস্ত বিপদ, বাধা বিঘ্ন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
আমরা বিপদতারিণী বা বিপদনাশিনী দেবীর যে ধ্যান মন্ত্র পাঠ করি তা হল ‘ওঁ কালাভ্রাভাং কটাক্ষৈররিকুলভয়দাং মৌলীবন্ধেন্দুরেখাম্ । শঙ্খং চক্রং কৃপাণং ত্রিশিখমপি করৈরুদ্বহন্তীং ত্রিনেত্রাম্ । সিংহাস্কন্ধাধিরুঢ়াং ত্রিভুবন – মখিলং তেজসা পুরয়ন্তীম্ । ধ্যায়েদ্ দুর্গাং জয়াখ্যাং ত্রিদশপরিবৃতাং সেবিতাং সিদ্ধিকামৈঃ ।
এখানে, কালাভ্র আভাং এর অর্থ কিন্তু দুই প্রকার হয়, একটি স্বর্ণ বর্ণা অপরটি কালো মেঘের ন্যায়), কটাক্ষে শত্রুকূলত্রাসিণী, কপালে চন্দ্রকলা শোভিতা, চারি হস্তে শঙ্খ, চক্র, খড়্গ ও ত্রিশূল ধারিণী, ত্রিনয়না, সিংহোপরি সংস্থিতা, সমগ্র ত্রিভুবন স্বীয় তেজে পূর্ণকারিণী, দেবগণ-পরিবৃতা।সিদ্ধসঙ্ঘ সেবিতা জয় দুর্গার ধ্যান করি।
এই জয়দুর্গা বা কৌশিকীদেবী ( এই কৌশিকীদেবীর উৎপত্তি হয়েছিলো পরমেশ্বর ভগবান শিবের অর্ধাঙ্গিনী দেবী পার্বতীর কৃষ্ণ কোশ থেকে- তাই তিনি কৌশিকী), বিপদতারিণীদুর্গা যিনি পঞ্চদেবতার একজন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে এই দেবীর অনেক রূপ দেখা যায়, উত্তর ভারতে অষ্টাদশ রূপের ধ্যান ও পূজা হয়, আবার কোথাও তাঁকে দশভুজা রূপে পূজা হয়, কোথাও আবার চতুর্ভুজা স্বর্ণ বর্ণা আবার কোথাও কৃষ্ণ বর্ণা রূপে পূজিতা হয় । আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষ দ্বিতীয়ার পরের মঙ্গল ও শনিবারে মায়ের পূজো হয় । যেখানে তেরো প্রকার ফল, পুস্প, মিষ্টি, পান সুপারী দিয়ে মাকে পূজা করা হয়। তবে, বাংলাদেশে দেবীর পূজার নিয়ম বিধি সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে গ্রামাঞ্চলে বিপত্তারিণী পূজা চলে চারদিন ধরে। প্রথম দিনে দেবীর “আরাধনা” (পূজা) করা হয়। মেয়েরা দণ্ডী কাটেন, তারপর দুই রাত্রি ধরে রাতে বাংলা লোকগান, ভজন ও কীর্তন চলে। চতুর্থ দিনে হয় বিসর্জন। বিপত্তারিণী পূজা উপলক্ষে মেয়েরা উপবাস করেন। প্রথা অনুসারে হাতে “তাগা” (এক গুচ্ছ পবিত্র লাল সুতো ও দূর্বাঘাস) বাধা হয়। কিন্তু কেন এই দেবীকে তেরো প্রকারের দ্রব্য দিয়ে পূজা করা হয়? তার কারণ কোন ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ নেই, এ হয়তো বা লোকাচার।
কিছু কিছু অঞ্চলে আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠীতে, সন্তান কামনার জন্য পালন করা হয় ষষ্ঠীব্রত সেই ষষ্ঠীর নাম ‘কোঁড়া ষষ্ঠী’ বা ‘কার্দমী ষষ্ঠী’ বা ‘কর্দ্দমষষ্ঠী’। এই ষষ্ঠীব্রতের দিনে মায়েরা দেবী ষষ্ঠীকে তেরোটি ফুল, তেরোটি ফল, তেরোটি পান, তেরোটি সুপারি, তেরোটি দুর্বা দিয়ে পূজা করেন। সম্ভবতঃ সেখান থেকে এই তেরো ফল-ফুল-পান –সুপারী ইত্যাদি এই পূজায় অন্তর্গত হয়েছে যেহেতু এই দুই পূজার সময়কাল প্রায় এক। আবার অনেকে মনে করেন এই ষষ্ঠীদেবী আর মা বিপদ-তারিণী একই দেবী। তবে সে যাই হোক ভক্তের ভক্তিভাব স্ফুরণের জন্যে, শ্রদ্ধার জন্যে দেবীকে যে ভাবেই পূজা করা হোক না কেন, তিনি আমাদের আরাধ্যা হউন। ভক্তের ত্রাস দূর করে জগতকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বিপদন্মুক্ত করুন এই প্রার্থনা রাখি।
নীচের চিত্রগুলি দেবীর বিভিন্ন রূপের প্রকাশ, ভক্ত মানসে তিনি যেভাবে স্থান নিয়েছেন। উপরের ছবি আমাদের ঘরের দেবী কিন্তু নীচের ছবি গুলি গুগোল চিত্র থেকে সংগৃহীত
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সোনারপুর অঞ্চলের রাজপুরে বাবা দুলাল নামে এক ভক্তসাধক মায়ের বিপত্তারিণী রূপের সাধনা করেন ও তিনি মাকে সিংহবাহিনী চতুর্ভুজা কালী রূপে দর্শন করেন। সেই বাবা দুলালের সাধনা এখন সর্বজনবিদিত। রাজপুরের এই মা বিপত্তারিণী চন্ডীর মহিমা এখন প্রায় সকলেই জানেন।
এর মধ্যে আপনারা দেবীর কোনরূপে আরাধনা করেন?? বা আর অন্য কোন রূপ আছে কি? জানতে দেবেন।
সঙ্কলক
শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী
সাধারনতঃ পঞ্জিকায় আমরা যে ছবি পাই

রাজপুরের বিপদতারিণী চন্ডী বাড়িতে মা



Saturday 19 June 2021

দশহরা বা গঙ্গা পূজা

 দশহরা বা গঙ্গা পূজা






গামীকাল জ্যৈষ্ঠ  মাসের শুক্লা দশমী,  দশহরা বা গঙ্গা পূজা।এই দিনই রাজা ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মা গঙ্গা পৃথিবীতে নেমে আসেন। সেই দিনের তিথি ছিল জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা দশমী। স্কন্ধপুরাণে আছে এই দিনে গঙ্গায় স্নান করে, গঙ্গাকে দশটি ফুল, দশটি ফল ও দশটি প্রদীপ দিয়ে পুজো করলে আমাদের জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করা দশটি পাপ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। দশ পাপ হরণ হয় বলেই এই তিথি কৃত্যের নাম দশহরা, এ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিথি।
আসুন দেখে নেই এই দশপ্রকার পাপ কি? কি? যা থেকে এই দিনে মুক্তিলাভ সম্ভব
পরদ্রব্য হরণ, অযথা হিংসা অর্থাৎ বৃথা প্রাণী হত্যা ও পরদার গমন অর্থাৎ অবৈধ প্রণয় এই তিনটি হলো আমাদের দেহগত পাপ। অহংকারী বাক্য, মিথ্যা কথা বলা, পরনিন্দা এবং অসংবদ্ধ প্রলাপ বা বাজে বকা— এই চারটি হলো আমাদের বাক্যগত পাপ।মনে মনে পরের দ্রব্যের কামনা, পরের অনিষ্ট চিন্তা এবং মিথ্যার প্রতি আসক্তি— এই তিনটি হলো আমাদের মানসিক পাপ।
গঙ্গা নদীর বর্ণনা আমরা বৈদিক যুগ থেকেই পাই, পুরাণ মতে গঙ্গা স্বর্গের দেবী।তপস্যার দ্বারা এই দেবীকে মর্তে এনেছিলেন সগর রাজার বংশজ রাজা ভগীরথ, যিনি আবার ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। পৌরাণিক আখ্যানে আছে সগর রাজার ছিলো ষাট হাজার পুত্র, কিন্তু সকলেই তাঁদের পাপকর্মের ফলে মহাসাধক কপিল মুনির অভিশাপে পড়েন এবং যোগবলে কপিলমুনি তাঁদের সকলকে ভস্ম করে দেন। কপিল মুনির অভিশাপে ভস্ম হলে,তাদের মুক্তিলাভের জন্য স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে আনতে দেবী গঙ্গার তপস্যা করতে করতে একে একে রাজা সগর, অসমঞ্জ, অংশুমান, দিলীপ রাজা দেহ ত্যাগ করেন,অবশেষে দিলীপ পুত্র ভগীরথ সফল হয়ে গঙ্গাকে মর্তে আনতে পারেন। সেইদিন ছিলো জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা দশমী।
বৈদিক যুগের কোনও এক সময়ে দশহরা তিথি থেকেই বৎসর গণনা শুরু হতো তাই দশহরা সেদিন নববর্ষের পূর্ণ মর্যাদায় ছিলো। দশহরার প্রধান কাজ হলো গঙ্গায় স্নান করা, কিন্তু যারা দূরে আছেন বা বিভিন্ন কারনে অক্ষম তাঁরা কি করবেন??? নিজের স্নানের জলে দু-তিন ফোঁটা গঙ্গা জল মিশিয়ে এই মন্ত্র
‘নমঃ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু

পাঠ করুন, বিশ্বাস এই মন্ত্রের সাহায্যে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, ও কাবেরীকে স্মরণ করে স্নানের জলে এই নদীগুলির পবিত্রতা ও শুদ্ধতা এনে নিজের জীবন কে শান্তি ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ করা যায়। পরে হাতজোড় করে
‘নমঃ কুরুক্ষেত্র গয়া গঙ্গা প্রভাস পুষ্করিণী চ
তীর্থান্যেতানি পুণ্যানি স্নানকালে ভবন্ত্বিহ’

এই বলে স্নান করে নিন, গঙ্গা স্নান হয়ে যাবে। অবশ্য এতে আস্থা থাকা চাই, কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।
ভালো থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী
৪ই আষাঢ়,১৪২৮বঙ্গাব্দ
১৯শে জুন,২০২১ইং
ছবিঃ-সৌজন্যেঃ গুগোল

Tuesday 8 June 2021

সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রত


ছবিঃগুগল চিত্র

প্রসঙ্গঃ সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রত
আজ থেকে শুরু হয়েছে সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রত, এই তিনদিন দেবী সাবিত্রী, সাবিত্রী সত্যবান ও ধর্মরাজের পূজা হয়ে থাকে। সাবিত্রী চতুর্দ্দশী ব্রতকথা অনুযায়ী -- মদ্র দেশের রাজা ছিলেন অশ্বপতি এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন মালবী। তাঁদের কোন সন্তানাদি ছিলো না, তাই সন্তানের প্রত্যাশায় তাঁরা দেবীসাবিত্রীর আরাধনা করতে লাগলেন। সাবিত্রীদেবী খুশি হয়ে বর দিলেন এক কন্যা সন্তানের। সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী সাবিত্রীদেবীর বরে জন্ম বলে কন্যার নাম রাখলেন সাবিত্রী। দেখতে দেখতে সাবিত্রী বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলেন। অশ্বপতি কন্যাকে নিজেই নিজের উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণ করতে বললেন। সাবিত্রী বিভিন্ন স্থান ঘুরে এসে পিতাকে জানালেন যে শাল্ব দেশের রাজা দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানকে তিনি মনে মনে স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন। এবারে রাজা অশ্বপতি দেবর্ষি নারদের শরণাপন্ন হলেন সত্যবানের পরিচয় জানতে, এতে দেবর্ষি বলেন সত্যবান হলেন শাল্বদেশের রাজা দ্যুমৎসেন ও তাঁর স্ত্রী শৈব্যার একমাত্র পুত্র সন্তান ও শাল্বদেশের যুবরাজ, কিন্তু ঘটনাক্রমে দ্যুমৎসেন অন্ধ হয়ে গেলে তাঁর শত্রুরা তাঁকে রাজ্যচ্যুত করেন। এরফলে রাজা সপরিবারে বনবাসী হন এবং বনে এসে দ্যুমৎসেন সস্ত্রীক তপস্যা করতে থাকেন। সত্যবানও তাঁর মাতাপিতার সেবা করে তাপসের জীবনযাপন করতে শুরু করেন। বাল্যকালে সত্যবান ঘোড়া ভালোবাসতেন এবং মাটি দিয়ে অশ্বমূর্তি নির্মাণ করতেন। সে জন্য সত্যবানের অপর নাম চিত্রাশ্ব।রাজা অশ্বপতির এই ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। তখন রাজা তাঁর পরামর্শ জানতে চাইলেন। তখন নারদ জানালেন আরো ভয়ানক কথা, সত্যবান সুদর্শন, সত্যবাদী, দাতা ও ব্রাহ্মণসেবী সত্যি কিন্তু তার আয়ু আর এক বছর। এক বছর পরই তার মৃত্যু ঘটবে। অশ্বপতি সে কথা শুনে কন্যাকে অন্য কোন পাত্রকে বরণ করতে বললেন। কিন্তু সাবিত্রী এতে রাজি হলেন না। সবিত্রী বললেন, ‘মনে মনে যাকে একবার স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছি। তিনিই আমার স্বামী। আমি আর অন্য কাউকে নিজের স্বামী হিসেবে বরণ করতে পারবো না।’ কন্যার যুক্তি মেনে নিলেন অশ্বপতি। সত্যবানের সঙ্গেই সাবিত্রীর বিয়ে হল। সাবিত্রী হিসাব রাখছিলেন, কখন এক বছর পূর্ণ হয়। অবশেষে যখন একবছর পূর্ণ হতে আর মাত্র চার দিন বাকী তখন তিনি উপবাস শুরু করলেন। যে দিন সত্যবানের মৃত্যুর দিন সেদিন সাবিত্রী সত্যবানের সাথে সাথে থাকলেন প্রতি মুহূর্ত। সে দিন সত্যবান বন থেকে কাঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করতে বনের গভীরে যাচ্ছেন দেখে সাবিত্রীও তাঁর সঙ্গ নিলেন। যদিও সাবিত্রী উপবাসে দুর্বল দেখে সত্যবান নিতে চাইছিলেন না, কিন্তু সাবিত্রী তা মানলেন না। সত্যবানের সাথেই গেলেন। এক মুহূর্তের জন্যও তাকে চোখের আড়াল হতে দিলেন না। কাঠ কাটতে কাটতেই সত্যবান অসুস্থ বোধ করলো। বললো প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। সাবিত্রী সত্যবানকে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে বললেন। সত্যবান তাই করলো। শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। তখন এক ভয়ঙ্কর পুরুষ এসে একহাতে সত্যবানের প্রাণ আর হাতে প্রাণহীন দেহ নিয়ে চলতে শুরু করলে সাবিত্রীও কোন কথা না বলে তাঁর পিছু পিছু চলতে শুরু করলেন। যম সাবিত্রীকে বললেন যে, স্বামীর প্রতি ওঁর যা কর্তব্য তা সম্পন্ন হয়েছে, এখন বাড়ি ফিরে যেতে, কিন্তু সাবিত্রী থামলেন না। যমকে বললেন, স্বামীছাড়া কোন নারীর পক্ষে নির্জন বনে ধর্ম মেনে চলা সম্ভব না। তারপর তিনি যমকে ধর্মকথা শোনাতে লাগলেন। যম তাতে তুষ্ট হয়ে সত্যবানের জীবন ছাড়া আর যে কোনও বর চাইতে বললেন। সাবিত্রী তখন যমের কাছে তাঁর শ্বশুরের অন্ধত্ব দূর করে দিতে বললেন। যম সেই বর দিয়ে ক্লান্ত সাবিত্রীকে ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু কোনকথা না শুনে সাবিত্রী চলতেই থাকলেন। বললেন যে, প্রাণপতির কাছাকাছি থাকলে কোন স্ত্রী কখনো ক্লান্ত হয় না। এছাড়া যম সজ্জন, সুতরাং উনি সাধুসঙ্গ করছেন। যম তখন তুষ্ট হয়ে পতির জীবন ছাড়া আরেকটি বর দিতে চাইলেন। সাবিত্রী এবার বর চাইলেন যেন ওঁর শ্বশুর পুনর্বার তাঁর রাজ্য লাভ করেন। যম সেই বর দিলেন তারপর সাবিত্রীকে বললেন আর পরিশ্রম না করে ফিরে যেতে। সাবিত্রী না ফিরে যমকে সনাতন ধর্মের কথা শোনালেন। যম তাতে প্রীত হয়ে সাবিত্রীকে পতির জীবন ছাড়া অন্য কোনও বর চাইতে বললেন। সাবিত্রী বললেন যে, ওঁর পিতা রাজা অশ্বপতি আজও পুত্রহীন - তাঁর যেন শতপুত্র হয়। যম বর দিয়ে বললেন, অনেক দূরে চলে এসেছো, এবার ফিরে যাও সাবিত্রী। সাবিত্রী বললেন, এটা আমার কাছে দূর নয়, আমি আমার স্বামীর সাথে সাথেই রয়েছি। তারপর যমের প্রশংসা করে বললেন যে, যম সমবুদ্ধিতে প্রজাশাসন করেন বলে তিনি ধর্মরাজও। যম হলেন সজ্জন। নিজের চেয়েও সজ্জনদের উনি বেশি বিশ্বাস করেন। সুতরাং নিজের ক্ষতি নিয়ে তাঁর কোন দুশ্চিন্তা নেই। যম খুশি হয়ে বললেন, সত্যবানের জীবন ছাড়া তিনি আরেকটি বর দিতে চান। সাবিত্রী এবার চাইলেন, ‘আমার গর্ভে যেন সত্যবানের ঔরসে বলশালী শতপুত্র হয়’। যম সাবিত্রীর প্রার্থিত বর দিয়ে বললেন, ধর্মকন্যা, এবার ফিরে যাও। কিন্তু সাবিত্রী আবারো যেতে থাকলেন আর ধর্মকথা শুনাতে থাকলেন। সাবিত্রীর ধর্মসম্মত কথা শুনে যম খুব সন্তুষ্ট হয়ে আর একটা বর দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন সাবিত্রী বলেন যে যমরাজ স্বয়ং ধর্মপ্রাণ ও নিতীপরায়ন তিনিই বর দিয়েছিলেন যে সাবিত্রী সত্যবানের ঔরসে পুত্রলাভের সৌভাগ্য লাভ করবেন এবং সেই সত্য রাখতে যমরাজকে সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে দিতেই হবে। এবারে নিজের বাক্যের সত্য রক্ষা করতে গিয়ে যম সাবিত্রীকে পঞ্চম বর দিতে বাধ্য হন এবং অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ সত্যবানের আত্মা সাবিত্রীকে ফিরিয়ে দিয়ে
সাবিত্রীকে আশীর্বাদ করে বিদায় নেন। এরপর সাবিত্রী সত্যবানের অচেতন শরীরের কাছে এসে, তাঁর মাথা কোলে তুলে নিয়ে বসেন এবং অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ সত্যবানের আত্মা সত্যবানের দেহে স্থাপন করেন। পরে সত্যবানের সংজ্ঞা ফিরে এলে, উভয়েই আশ্রমে ফিরে যান।এইভাবে ধর্ম দিয়ে, সততা দিয়ে সাবিত্রী তাঁর স্বামীর জীবন রক্ষা করলেন। পরদিন আশ্রমে ফিরে ব্রতের পারনা করেন ও সকল আশ্রম বাসীর কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন, তখন সকল আশ্রম বাসীরা সাবিত্রীর জয়গান করতে থাকেন এদিকে যমের আশীর্বাদে দ্যুমৎসেনের চক্ষু ও রাজ্যলাভ এবং অশ্বপতির শতপুত্র ও লাভ হয়। সাবিত্রীর স্বামীর প্রতি এই প্রগাঢ় ভালোবাসা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে সতী নারী হিসেবে।
সঙ্কলকঃ শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

Friday 23 April 2021

গোপালের ডান বুকে একটি পায়ের ছাপ আছে......কার সেটি?

 আপনাদের যাদের ঘরে গোপালের মুর্ত্তি আছে তাঁরা হয়তো লক্ষ্য করেছেন গোপালের ডান বুকে একটি পায়ের ছাপ আছে। জানেন কি এই পায়ের ছাপটি কার? হয়তো বা আপনারা অনেকেই জানেন। যারা জানেন না তাঁদের জন্যে তুলে ধরছি এর কারন।

এক কাহিনী  অনুসারে

একবার সকল দেবতারা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মধ্যেকে শ্রেষ্ঠ কে, তা জানার জন্য মহর্ষি ভৃগুর শরণাপন্ন হন। মহর্ষি ভৃগু তখন এই তিন দেবতাদের পরীক্ষার জন্য সর্ব প্রথম ব্রহ্মার কাছে যান এবংতিনি ইচ্ছা করে ব্রহ্মার প্রতি সম্মান না দেখালে, ব্রহ্মা তাঁর প্রতি তীব্র ক্রোধ প্রকাশ করেন। পরে স্তব দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করে মহাদেবের কাছে যান। মহাদেবকে সম্মান না দেখানোর কারণে, মহাদেব তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হন, এবারও ভৃগু স্তব করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। এরপর ইনি বিষ্ণুকে পরীক্ষা করার বিষ্ণুর আবাসস্থল গোলকধামে যান। সেখানে বিষ্ণুকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখে ইনি বিষ্ণুর বক্ষে পদাঘাত করেন।বিষ্ণু ঘুম থেকে জেগে উঠে ভৃগুর পায়ে আঘাত লেগেছে মনে করে  পদসেবা করতে থাকেন।   বিষ্ণু মহর্ষি ভৃগুর পা ধরলেন এবং এমনভাবে হাত বুলাতে লাগলেন, যাতে ঋষির আরাম বোধ হয়। বেদে আছে, ঋষি ভৃগুর পায়ের পাতায় একটি অতিরিক্ত চোখ ছিল। এই কাজ করার সময় বিষ্ণু ঋষির অতিরিক্ত চোখটিতে চাপ দিলেন। কথিত আছে, ঋষির এই অতিরিক্ত চোখটি ছিল তার অহংকারের প্রতীক। ঋষি তখন  তাঁর  ভুল বুঝতে পেরে বিষ্ণুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সেই থেকে তাঁর বোধ হল ত্রিমূর্তির মধ্যে বিষ্ণুই শ্রেষ্ঠতম।এরপর ভৃগু বিষ্ণুকেই শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসাবে স্বীকৃতি দেন। উল্লেখ্য এরপর থেকে বিষ্ণুর বুকে ভৃগুর পদচিহ্নের ছাপ পড়ে যায়।

ভগবান শ্রী বিষ্ণু বা গোপালের বিগ্রহ যখনই তৈরি করা হয় তখনি ভগবানের ডান বক্ষের দিকে ভৃগু মুনির চরণ অঙ্কন করা হয়। ভৃগু মুনির চরণের ছাপ ছাড়া গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহ সম্পূর্ণ হয় না।

(চলবে)

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...