ধনতেরাস
সংকলকঃ শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত ধনতেরাস আসলে আর কিছু নয় ধনাত্রয়োদশী বা ধনবত্রী ত্রয়োদশী। আমাদের সনাতন ধর্মের চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে কার্ত্তিক মাসের তেরোতম দিন অর্থাৎ ত্রয়োদশী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। এর নেপথ্যে পুরাণের মধ্যেই অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন
পুরাণে আছে হিম রাজা ও তাঁর ষোলো বছরের পুত্রের কাহিনী।
রাজপুত্রের কোষ্ঠী অনুসারে রাজপুত্রের বিয়ের পরেই সাপের কামড়ে মৃত্যু যোগ ছিলো। যেমনটা আমরা মনসামঙ্গলে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গল্পে পাই। এই ব্যাপারটি নব-বধুর কানে আসতেই বিয়ের রাতে সেই নববধু রত্নালঙ্কারের জৌলুসে যমের সঙ্গী সাপের চোখ ধাঁধিয়ে রাখার জন্যে ধনরত্ন, নুতন বাসন সামগ্রী বাসর ঘরের প্রবেশ দ্বারে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেই বিস্বাসে আজও নিজের ঘর ও পরিবার পরিজনদের সুরক্ষিত রাখতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধনতেরাস উদযাপন করা হয় আর সন্ধ্যাতে যে দীপ জ্বালানো হয় তাকে বলা হয় যমদীপদান।
আবার আরেক পুরাণে আছে,
একসময় দুর্বাসা মুনির অভিশাপে ধন ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী শ্রীহীন ও গৃহহারা হয়ে যান যার ফলে সমগ্র স্বর্গরাজ্যে অন্ধকার নেমে আসে, এরপর যখন দেবতারা অসুরদের সাথে সমুদ্রমন্থন করেন সেই সময় স্বর্গের দেবী মা লক্ষ্মীকে ফিরে পেয়েছিলেন আর সেই দিন ছিলো কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী, সে থেকে এই তিথিতে ধনতেরাস পালিত হয়, ধন সৌভাগ্যাদির আশায়।
......আবার পুরাণের আরেক গল্পে আছে, ইন্দ্রের অভদ্র আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মহর্ষি দুর্বাসা তিন লোককে শ্রীহীন হওয়ার অভিশাপ দেন। এর ফলে পৃথিবী থেকে নিজের লোকে গমন করেন অষ্টলক্ষ্মী। জগৎ সংসারে শ্রী প্রতিষ্ঠার জন্য সমুদ্র মন্থনের পরামর্শ দেন শিব। দেবতা ও অসুরেরা মিলে তখন সমুদ্র মন্থন করছিলেন আর সেই সমুদ্র মন্থনের সময় হাতে অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হয়েছিলেন এই তিথিতেই। কথিত, সমুদ্র মন্থনের ফলে চৌদ্দটি প্রমুখ রত্নের উৎপত্তি হয়। চতুর্দশ রত্ন হিসেবে স্বয়ং অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হন। আর সেইদিনই পালিত হয় ধনতেরাস আর এর ঠিক দুদিন পর প্রকট হন মহালক্ষ্মী। তাই ধনতেরাসের দুদিন পর দীপাবলীতে মহালক্ষ্মী পুজো করা হয়।
বিষ্ণু ধন্বন্তরীকে দেবতাদের বৈদ্য এবং বনস্পতি ও ঔষধির অধিপতি নিযুক্ত করেন। তাঁর আশীর্বাদেই সমস্ত বৃক্ষ ও বনস্পতির মধ্যে রোগনাশক শক্তির সঞ্চার হয় বলে বিশ্বাস।
সমুদ্র মন্থনের সময় শরৎ পূর্ণিমায় চাঁদ, কার্তিক দ্বাদশীর দিনে কামধেনু, ত্রয়োদশীর দিনে ধন্বন্তরী ও অমাবস্যার দিনে মহালক্ষ্মীর উৎপত্তি হয়। জনকল্যানের জন্য ধন্বন্তরীই অমৃতময় ঔষধির খোঁজ করেন। তাঁর বংশেই শল্য চিকিৎসার জনক দিবোদাস জন্ম গ্রহণ করেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র সুশ্রুত তাঁর শিষ্য ছিলেন যিনি আয়ুর্বেদের মহানতম গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতার রচনা করেন।
স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এইদিনে ধন্বন্তরীর উপাসনা করা হয়। এদিন ধন- সমৃদ্ধির জন্য কুবেরেরও পুজো করা হয়। পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী, ধনতেরাসের দিনে বিধি মেনে পুজো করলে ও দীপ দান করলে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে নিশ্চিত মুক্তি পাওয়া যায়।
অপর এক পৌরাণিক গল্প অনুসারে:
এক সময় ভগবান বিষ্ণু নরলোকে বিচরণ করতে এলে, লক্ষ্মীও তাঁর সঙ্গ নেন। লক্ষ্মী স্বভাবত চঞ্চলা তাই তখন বিষ্ণু বলেন, তাঁর কথা মেনে চললেই লক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে যেতে পারেন। সেই শর্তে রাজী হয়ে লক্ষ্মী বিষ্ণুর সঙ্গে পৃথিবীতে আসেন।একটি স্থানে এসে বিষ্ণু লক্ষ্মীকে অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন এবং তাঁর না-আসা পর্যন্ত লক্ষ্মী যেন সেখান থেকে কোথাও না-যান। লক্ষ্মীর মনে দক্ষিণ দিকে বিষ্ণুর গমনের কারণ জানার কৌতূহল জাগ্রিত হয়। এর পর তিনিও বিষ্ণুর পিছু নেন। কিছু দূর এগোনোর পর সরষের খেতে ফুল ফুটে থাকতে দেখে, সেই ফুল দিয়ে লক্ষ্মী শৃঙ্গার করেন ও তার পর ফের অগ্রসর হন। কিছু দূর যাওয়ার পর ইক্ষুর খেত থেকে ইক্ষু তুলে তার রস পান করেন। সে সময় বিষ্ণু সেখানে আসেন ও লক্ষ্মীকে দেখে ক্ষুব্ধ হন। এর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে অভিশাপ দেন। বলেন, বারণ সত্ত্বেও লক্ষ্মী তাঁর পিছু নেন ও দরিদ্র কৃষকের খেত থেকে চুরির অপরাধ করে বসেন। লক্ষ্মীকে বারো বছর পর্যন্ত কৃষকের সেবা করতে বলে ক্ষীরসাগরের উদ্দেশে প্রস্থান করেন বিষ্ণু। সেইসময় একদিন লক্ষ্মী কৃষকের স্ত্রীকে স্নান করে লক্ষ্মী পুজো ও তার পর রান্না করার কথা বলেন। পুজোর পর কৃষক-পত্নীর সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হবে বলে জানান লক্ষ্মী। কৃষক-পত্নী তেমনই করেন। ফল স্বরূপ দ্বিতীয় দিনই কৃষকের ঘর অন্ন, রত্ন, ধনে ভরে যায়।
এভাবে ১২ বছর পর্যন্ত আনন্দে কাটে কৃষকের সময়। বারো বছর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিতে এলে কৃষকের স্ত্রী তাঁকে যেতে দেন না। তখন বিষ্ণু জানান, লক্ষ্মীকে কেউ যেতে দিতে চায় না। লক্ষ্মী চঞ্চলা, কোথাও টিকতে পারেন না। তখন লক্ষ্মী ওই কৃষককে জানান, তাঁর কথা মতো চললে, পরিবারে কখনও অর্থাভাব থাকবে না। ধনতেরাসের দিনে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করার কথা বলেন লক্ষ্মী। এর পর রাতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে সন্ধাকালে পুজো করতে বলেন। লক্ষ্মী কৃষককে বলেন, একটি রুপোর ঘটে তাঁর জন্য টাকা ভরে রাখতে। তিনি সেই ঘটেই অবস্থান করবেন।
আবার অপর
একটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, রাজা বলির ভয় থেকে দেবতাদের মুক্তি
দেওয়ার জন্য বিষ্ণু বামন অবতার নেন। এর পর তিনি বলির যজ্ঞ স্থলে পৌঁছন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য বামন
রূপী বিষ্ণুকে চিনে ফেলেন। রাজা বলিকে শুক্রাচার্য সাবধান করে বলেন যে, বামন
রূপে বিষ্ণু সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তাই বামন যা চাইবে, তা
যেন দেওয়া না-হয়। কারণ বামন রূপী বিষ্ণু দেবতাদের সহয়াতার জন্য সেখানে প্রকট
হয়েছেন। কিন্তু
শুক্রাচার্যের কথা অমান্য করে বামন রূপী হরির প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বামনের তিন পা
সমান ভূমি দান করতে রাজি হয়ে যান। শুক্রাচার্য
এই দান বিফলে যাওয়ার জন্য লঘু রূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কমণ্ডলে প্রবেশ করেন। বামনও
শুক্রাচার্যের ছল বুঝতে পেরে নিজের হাতে থাকা কুশকে কমণ্ডলে এমন ভাবে প্রবেশ করান, যার
ফলে শুক্রাচার্যের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
এর পর বলি
বামনকে তিন পা সমান জমি ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। বামন নিজের একটি পা দিয়ে
সম্পূর্ণ পৃথিবী ও অপর পা দিয়ে অন্তরীক্ষ মেপে নেন। কিন্তু তৃতীয় পা রাখার জন্য
কোনও স্থান বেঁচে না-থাকার কারণে রাজা বলি নিজের মস্তক বামন রূপী বিষ্ণুর পায়ের
তলায় রেখে দেন। এ ভাবে দেবতারা বলির ভয় থেকে মুক্তি পায়। এই জয়ের উৎসব হিসেবে
ধনতেরাস পালিত হয়।
ধনতেরাসের শুভ লগ্নে সমৃদ্ধি কামনায় গৃহস্থ বাড়িতে কেনা হয় মূল্যবান ধাতু ৷ সমৃদ্ধি লাভের জন্যই ধাতু কেনার প্রচল এই সময় ৷ তার এক প্রচলিত গল্প আছে...।।
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে ধন্বন্তরীর
জন্ম। সাগর মন্থনের সময় লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন ধন্বন্তরীও. ধন-সম্পদের
দেবী লক্ষ্মী, কিন্তু তাঁর কৃপা পাওয়ার জন্য সুস্থ জীবন
ও দীর্ঘ আয়ু দরকার। সাংসারিক সুখ-সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের কামনার জন্য ধন্বন্তরীর
ও পুজো করা হয় এদিন।ধন্বন্তরী যখন
সমুদ্র মন্থনের সময় প্রকট হয়েছিলেন, তখন তাঁর হাতে ছিল অমৃত কলস। আর
সেই কারণে ধনতেরাসের সময় বাসন কেনার চল রয়েছে বলে মনে করা হয়, ধনতেরাসের
সময় সোনার বা অন্য কোনও ধাতুর গয়না কিনলে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। শাস্ত্রমতে, এই সময় নিজের ক্ষমতা
অনুযায়ী, যেকোনও শুদ্ধ ধাতুই কেনাই মঙ্গলজনক ৷এইদিনে সোনা কেনার চল আছে৷
সোনা না পারলে রুপো বা অন্য কোনও ধাতুও কিনতে দেখা যায়৷ ফলে অনেককে ধনতেরাসের
দিনে বাসন কিনতেও দেখা যায়
তবে জ্যোতিষ
শাস্ত্রমতে, বিভিন্ন রাশির জন্য বিভিন্ন ধাতু কেনা উচিত ৷তবেই
ধনতেরাস এর প্রকৃত ফললাভ সম্ভব। রাশি অনুযায়ী যেগুলির নির্দেশ আছে তা হল......
মেষ রাশি : সোনা
কিনুন ৷ সোনা রাখুন লক্ষ্মীর সামনে ৷
বৃষ রাশি : সোনা
ও রুপো কিনে ঠাকুর ঘরে রাখুন৷
মিথুন রাশি : সোনা
নতুবা রুপো কিনতে পারেন ৷
কর্কট রাশি : ধনতেরাসে
কিনতে পারেন পিতল ৷
সিংহ রাশি : সোনা
বা পিতল কিনতে পারেন ৷
কন্যা রাশি : সোনা
কিনে রাখুন ঠাকুর ঘরে।
তুলা রাশি : সোনা
বা রুপো কিনুন।
বৃশ্চিক রাশি : পিতল
কিনুন৷
ধনু রাশি : রুপো
কিনুন।
মকর রাশি : রুপো
কিনে রাখুন ঠাকুর ঘরে
কুম্ভ রাশি :পিতল
কিনুন৷
মীন রাশি : রুপোর কিছু কিনে ঠাকুর ঘরে রেখে দিন ৷
সংসারে সুখ ও শান্তি বজায় রাখতে এদিন অনেকের বাড়িতেই
লক্ষ্মী ও গণেশের পুজো করা হয়. ধনতেরাসের দিনে ঘরে প্রদীপ জ্বালাতে হয়.
বলা হয়, কৃষ্ণপক্ষের এই তিথিতে যমের নামে পুজো দিলে অকালমৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া
যায়। আবার ধনতেরাসের দিন অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের
সূচনা হয়; তাই সেই দিন অনেকে নতুন বাসন, গয়না প্রভৃতিও কিনে থাকেন এই দিনে।
উত্তর ও পশ্চিম ভারতের প্রভাবে গত কয়েক বছর ধরে বাঙ্গালীদের
ঘরে ঘরেও ধনতেরাস উৎসবের প্রচলন দেখা
যাচ্ছে৷ তাই তো ধনতেরাসের দিন সোনার দোকানে-দোকানে বাঙ্গালীদেরও অনেক ভিড় জমাতে
দেখা যায়৷অনেকের কাছে বাঙ্গালীদের এইসব আচরন আদিখ্যেতা মনে হলেও আমার
কিন্তু মন্দ লাগে না, দৈনন্দিন নানা ঝামেলা ও অশান্তির মধ্যে এই সকল দিয়ে যদি একটু
মানসিক শান্তির খোঁজ চলে তবে মন্দ কি? আজকাল তো অনুকরনের যুগ সকল ব্যাপারেই অনুকরন
চলছে...... তবে সেই সকল অনুকরন ভালো যে
গুলো সমাজের জন্যে ইতিবাচক বার্তা বয়ে নিয়ে আসে...... তাই নয় কি? যদিও আমার ঘরে
তেমন কিছু এখনো শুরু হয় নি.........
(সংগৃহীত)
No comments:
Post a Comment