Tuesday 4 October 2016

দেবী প্রতিমা ও দেবী ধ্যান

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলতেন প্রতিমায় আবির্ভাব হতে গেলে তিনটি জিনিসের দরকার,- “প্রথম পূজারীর ভক্তি, দ্বিতীয় প্রতিমা সুন্দর হওয়া চাই, তৃতীয় গৃহস্বামীর ভক্তি”। আধুনিক কালের পূজাতে সেই ভক্তির অভাব অনেক ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। প্রতিমা পূজার প্রধান অঙ্গ হল প্রতিমা, সেই প্রতিমা সুন্দর না হলে পূজার সার্থকতা থাকে না, আবার প্রতিমা ধ্যানাযায়ী না হলে পূজারীর কাছে পূজা করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় । পূজার সাত্বিকতা হারিয়ে আজ অনেক ক্ষেত্রে তা রাজসিকতা ও তামসিকতায় পরিনত হয়েছে। মাতৃ আরাধনার প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আমরা তার আনুসঙ্গিকতায় অধিক মনোনিবেশ করেছি।আজকাল দেবী প্রতিমা আমাদের কাছে মনোরঞ্জনের এক বিষয় বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে, অধিকাংশ স্থানে মূর্তি তৈরি করা হয় বিভিন্ন আদলে, বিভিন্ন রূপে যার ফলে আমরা নিজেরা মাতৃ রূপ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত। সত্যি কথা বলতে কি আমরা অনেকেই জানি না আমাদের জগন্মাতা দেবী দুর্গার প্রকৃত স্বরূপ কি? ধ্যানে আমরা দেবীর যে রূপ বর্ণিত পাই তা আমাদের অনেকের কাছে অজানা তাই আজ যেখানে যেখানে সেই ধ্যানে বর্ণিত রূপে প্রতিমা তৈরি হয় তা আমাদের মনোগ্রাহী হয় না বরঞ্চ আমাদের কাছে কৌতূহলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ধ্যানে শুধু মায়ের রূপের বর্ণনাই নয়, মার কোন হস্তে কোন অস্ত্র তার ও বর্ণনা আছে। সকলের জ্ঞাতার্থে দেবীর ধ্যান মন্ত্র ও তার যথাসাধ্য অর্থ সকলের কাছে তুলে ধরছি,ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করবেন নিজের অজ্ঞতার জন্য আমি নিজেই ক্ষমাপ্রার্থী।
             দেবী দুর্গার ধ্যানমন্ত্র
ওঁ হ্রীং জটাজুটসমাযুক্তামর্দ্ধেন্দুকৃতশেখরাম্।
লোচনত্রয়সংযুক্তাং পূর্ণেন্দুসদৃশাননাম্।।
অতসীপুষ্পবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।
(তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।)
নবযৌবন-সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ-ভূষিতাম্।।
সূচারুদশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত-পয়োধরাম্।
ত্রিভঙ্গস্থানসংস্থানাং মহিষাসুরমর্দ্দিনীম্।।
মৃণালায়াত-সংস্পর্শ-দশবাহুসমন্বিতাম্।
ত্রিশুলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খড়্গং-চক্রং ক্রমাদধঃ।।
তীক্ষ্ণবাণং তথাশক্তিং দক্ষিণেন বিচিন্তয়েৎ।
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেবচ।।
ঘণ্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।
অধস্থান্মহিষং তদ্বদ্ধিশিরস্কং প্রদর্শয়েৎ।।
শিরোশ্ছেদোদ্ভবং তদ্বদ্দানবং খড়্গপাণিনম্।
হৃদিশূলেন নির্ভিন্নং নির্য্যদন্ত্রবিভূষিতম্।।
রক্তারক্তী কৃতাঙ্গঞ্চ রক্তবিস্ফুরিতেক্ষণম্।
বেষ্টিতং নাগপাশেন ভ্রূকুটিভীষণাননম্।।
সপাশবামহস্তেন ধৃতকেশঞ্চ দুর্গয়া।
বমদ্রুধিরবক্ত্রঞ্চ দেব্যাঃ সিংহং প্রদর্শয়েৎ।।
দেব্যাস্তু দক্ষিণং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।
কিঞ্চিদূর্দ্ধং তথা বামমঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি।।
স্তুয়মানঞ্চ তদ্রূপমমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকাম ফলপ্রদাং।।
উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডা চ চণ্ডগ্রাচণ্ডনায়িকা।
চণ্ডাচণ্ডবতী চৈব চণ্ডরূপাতিচণ্ডিকা।।
অষ্টাভিঃ শক্তিভিস্তাভিঃ সততঃ পরিবেষ্টিতাম্।
চিন্তয়েজ্জগতাং ধাত্রীং ধর্মকামার্থমোক্ষদাম্।।
ব্যাখ্যা
দেবীর মাথায় জটা, সাথে অর্ধচন্দ্রের মত কপাল। পূর্ণিমার চাঁদের মত মুখ তাঁর ও গায়ের রঙ অতসীফুলের মতো। তিনি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এবং তাঁর সর্বাঙ্গ বিভিন্ন অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত।
তাঁর দাঁত সুন্দর এবং ধারালো, স্তন সম্পূর্ণ। তিন ভাঁজে দাঁড়িয়ে তিনি দৈত্য নিধন করছেন। দশহাতভর্তি অস্ত্র তাঁর যা দেখতে শাখা-প্রশাখা সমন্বিত পদ্ম গাছের মতো। ডানদিকের উপরের হাতে অবস্থান করে ত্রিশুল, তারপর ক্রমান্বয়ে খর্গ এবং চক্র।
দেবীর দক্ষিণের সর্বনিম্ন দুই হাতের অস্ত্র ধারালো তীর এবং বর্শা। দেবীর ধ্যানে বর্ণিত হয় তাঁর বাঁ হস্ত। সেদিকে সবচেয়ে নিচের হাতে থাকে চামড়ার ঢাল ও তার উপরের হাতে ধনুক। সেগুলির উপরের হাতে থাকে সর্প, অঙ্কুশ এবং কুঠার (ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে)। দেবীর পায়ের কাছে দৈত্যরাজের মাথার স্থান।
মহিষের কাটা মাথা থেকে মহিসাসুরের দেহ অর্ধেক উত্থাপিত, হাতে তাঁর খর্গ এবং হৃদয়ে দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ। তাঁর পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি নির্গত হয়েছে। শরীর রক্তলিপ্ত। দেবীর হাতে ধরা সাপ দ্বারা অসুরের দেহ বেষ্টিত। তবে উত্থিত ভ্রূ তে দৈত্যের রূপও ভয়ঙ্কর। ।
দেবী তাঁর বাম হাত দিয়ে দৈত্যরাজের চুল টেনে রেখেছেন। দেবীর ডান পা বাহন সিংহের উপরে এবং বাঁ পা কিঞ্চিৎ উর্ধে মহিষের উপরে অবস্থান করে। প্রবল যুদ্ধরত অবস্থাতেও দেবী তাঁর শান্তিপূর্ণ মুখাবয়ব ও আশীর্বাদী রূপ বজায় রেখেছেন এবং সমস্ত দেবতা দেবীর এই রূপের স্তুতি করেন। ।
দেবীর উপরোক্ত রূপ দেবতাদের আট শক্তি উগ্রচন্ডা, প্রচন্ডা, চন্ডোগ্রা, চন্ডনায়িকা, চন্ডা, চন্ডবতী, চন্ডরূপ ও অতিচন্ডিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। গৃহকর্তার মানব জীবনের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেন এই দেবী। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের জন্য জগন্মাতৃকা দেবী দুর্গার ধ্যানই মানবজাতির করা উচিত। ।

No comments:

Post a Comment

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...