Saturday 22 October 2016

পিতৃ তর্পণ

পিতৃ তর্পণ
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

বর্তমানে বিভিন্ন পরিস্থিতির চাপে ও বিভিন্ন কারনে  আমাদের অনেককিছু আচার-অনুষ্ঠান প্রায় লুপ্ত ।পিতৃ তর্পণ ও তেমনই একটি, বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে আজ তার অর্থ অজানা। অনেকে হয়তো বা আবেগের বশে পিতৃ তর্পণ করে থাকেন কিন্তু কি করছেন বা কিসের জন্যে করছেন তা রয়ে যাচ্ছে অজানা। দুর্গা পূজার আগে পিতৃ পক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এই তর্পণ অনুষ্ঠান, আসুন জেনে নেই তার কিছু তথ্য।শাস্ত্র বিষয়ে আমি নিতান্ত অজ্ঞ বাংলা ভাশাতেও আমার জ্ঞান সীমিত, তাই ভুল ত্রুটি  নিজগুণে মার্জনা করবেন।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে এই পিতৃ পক্ষ কি?
   ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার পরের তিথি অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে পরের অমাবস্যা বা মহালয়ার দিন পর্যন্ত দিন গুলিকে পিতৃপক্ষ বলে জানা যায় এবং এই  পিতৃপক্ষে স্বর্গত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পার্বন  শ্রাদ্ধ ও তর্পন করা হয়। কথিত আছে যে এই সময় যমালয় থেকে মর্ত্যলোকে পিতৃ পুরুষেরা আসেন তাঁদের বংশধরের কাছে এবং তাদেরকে তৃপ্ত করার জন্য তিল,জল দান করা হয়। তাহাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্যে উল্কাদান ও করা হয়।  আমরা মহাভারতে পাই যে, মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খেতে দেওয়া হয় শুধু সোনা আর ধনরত্ন। তার  কারণ কর্ণ ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বললেন যে  যেহেতু তিনি  সারাজীবন শুধু সোনাদানাই দান করেছেন এবং পিতৃপুরুষকে জল  দান করার কথা ভুলেই গেছিলেন, তাই তার এই অবস্থা। উত্তরে কর্ণ বলেন যে  তাঁর  পিতৃপুরুষের পরিচয় তিনি যুদ্ধ শুরুর  আগের রাতেই জানতে পেরেছিলেন, যখন তাঁর মা কুন্তী  এসে  তাঁর জন্ম কাহিনিও পরিচয় দেন পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয় সেই হেতু পিতৃতর্পণ তিনি করতে পারেন  নাই ইন্দ্র বুঝলেন যে এতে কর্ণের কোন দোষ নেই। তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দেন  ইন্দ্রের কথা মতো এক পক্ষকাল ধরে কর্ণ মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল প্রদান করে নিজের পাপ দূর করেন। সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে। এই পিতৃ তর্পণের পরিচয় মার্কণ্ডেয় পুরাণে ও পাওয়া যায় সেখানে বলা হয়েছে যে পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন। পিতৃতর্পণে আমরা যাদের উদ্দেশ্যে  জল দান করে থাকি তা কিছুটা এই রকম... তর্পণের শুরুতে করা হয় দেব তর্পণ এই মন্ত্রে ‘ওঁ ব্রহ্মা তৃপ্যতাম্।। ওঁ বিষ্ণুস্তৃপ্যতাম্।ওঁ রুদ্রস্তৃপ্যতাম্।। ওঁ প্রজাপতিস্তৃপ্যতাম্। এই চার জন ছাড়া মন্ত্র ও জল দ্বারা দেব, যক্ষ, নাগ, গন্ধবর্ব, অপ্সরা, অসুর, ক্রুরস্বভাব জন্তু, সর্প, সুপর্ণ যা হল গরুড়জাতীয় পক্ষী ও  বৃক্ষ, সরীসৃপ, সাধারন পক্ষী, বিদ্যাধর কিন্নর, জলচর, খেচর, ভূত  এবং পাপে ও ধর্মকার্য্যেরত যত জীব আছে, তাহাদের তৃপ্তির জন্য তর্পণ করা হয় দেব তর্পণের পর করা হয় মনুষ্য তর্পণ মন্ত্রের অর্থ কিছুটা এই সনক, সনন্দ, সনাতন, কপিল,আসুরি, বোঢ়ু ও পঞ্চশিখ আপনারা সকলে আমার প্রদত্ত জলে সর্বদা তৃপ্তিলাভ করুন, এবং মন্ত্র ও জল দ্বারা আমরা মরীচি, অত্রি,অঙ্গিরা,পুলস্ত,পুলহ, ক্রতু,প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ প্রভৃতি ঋষি গনের তর্পণ করি।দিব্য-পিতৃ-তর্পণে আমরা সাতটি মন্ত্র দ্বারা প্রত্যেককে এক এক অঞ্জলি সতিল জল দিব্য পিতৃ গনের উদ্দেশ্যে দান করে থাকিতারপর, হে আমার পূর্ব্বপুরুযগণ  আসুন, এই অঞ্জলি পরিমিত জল গ্রহণ করুন বাক্যে আবাহন করা হয় পিতৃ পুরুষ গন কে ও ভক্তিসহকারে স্বর্গত পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধপ্রমাতামহ, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী, বৃদ্ধপ্রমাতামহী, গুরু, জ্যেঠা, খুড়া, বিমাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী, জ্যেঠী, খুড়ী, পিসি,মাসী, মাতুল, মাতুলানী, শ্বশুর, শাশুড়ী, ভগ্নিপতি, জ্ঞাতি, আদি যতজন যে সকল দেহত্যাগ করেছেন তাঁদের সকলের  নামে তর্পণ করা হয়।তর্পণের সবচাইতে সুন্দর যে অংশটি যা আমাকে অতিশয় অভিভূত করে সে হল আমার বংশে যে সকল জীব অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছেন, অর্থাৎ যাঁহাদের দাহাদি সংস্কার হইয়াছে  বা  যাঁহারা দগ্ধ হন নাই  অর্থাৎ কেহই তাঁহাদের দাহাদি-সংস্কার কার্য্য করেন নাই  তাঁদের তৃপ্তি ও স্বর্গ লাভের জন্যে ওঁ নমঃ অগ্নিদদগ্ধাশ্চ যে জীবা... এই মন্ত্র সহকারে জল দান করা ও  ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা...মন্ত্রে আমাদের যে সকল আমাদের বন্ধু ছিলেন এবং যে সকল আমার বন্ধু নন, যে সকল জন্ম-জন্মান্তরে আমাদিগের বন্ধু ছিলেন, এবং যারা আমাদের নিকট হইতে জলের প্রতাশা করেন, তাঁদের সম্পূর্ণরূপে তৃপ্তি লাভের জন্যে ও তর্পণ করা হয়। এরপর আমরা করি ভীষ্ম-তর্পণ, এই মন্ত্রের অর্থ কিছুটা এই যে    বৈয়াঘ্রপদ্য যাঁহার গোত্র,সাঙ্কৃতি যাঁহার প্রবর, সেই অপুত্রক ভীষ্মবর্ম্মাকে এই জল দিতেছি।শান্তনু-তনয় বীর, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় ভীষ্মবর্ম্মা এই জল দ্বারা পুত্র-পৌত্রচিত তর্পণাদি-ক্রিয়া-জনিত তৃপ্তি লাভ করুন। ভীষ্ম- তর্পণের পর করা হয় রাম-তর্পণ, সম্পূর্ণ তর্পণ করা সম্ভব না হলে  শুধু এই তর্পণ  করলেই হয় বলে বিশ্বাসশ্রীরামচন্দ্র বনবাস কালে এই মন্ত্রেই তর্পণ করেছিলেন বলে বর্ণিত আছে
মন্ত্রটি হল, মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে ব্রহ্মলোক অবধি যাবতীয় লোক সমীপে অবস্থিত জীবগণ,যথা যক্ষ, নাগাদি, দেবগণ, যথা ব্রহ্মা , বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি, ঋষিগণ যথা মরীঢি, অত্রি, অঙ্গিরাদি, পিতৃগণ,মনুষ্যগণ সনক, সনন্দ প্রভৃতি, পিতৃ-পিতামহাদি এবং মাতামহাদি সকলে তৃপ্ত হউন ।আমার কেবল এই জন্মের নয়, আমার বহুকোটিকুল, বহু জন্মান্তরে গত হইয়াছেন, সেই সকল কুলের পিতৃ-পিতামহাদি, সপ্তদ্বীপবাসী যথা জম্বু, প্লক্ষ, শাল্মলি, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক, পুষ্কর, সমুদয় মানবগণের পিতৃ-পিতামহাদি এবং ত্রিভুবনের যাবতীয় পদার্থ আমার প্রদত্ত জলে তৃপ্ত হউনতারপরে করা হয় লক্ষণ-তর্পণ, এও বিশ্বাস যে রাম-তর্পণেও অশক্ত হইলে এই তর্পণ করা হয়, কারণ বনবাসকালে রাম ও সীতার সেবায় ব্যাস্ত থাকার সময় সময়াভাবে, লক্ষণ শুধু যে মন্ত্রে তর্পণ করতেন তার অর্থ হল—‘ব্রহ্মা হইতে তৃণ পর্ষ্যন্ত জগৎ,জগতের লোক, স্থাবর জঙ্গমাদি, সকলে তৃপ্ত হউনতারপর বস্ত্র নিংড়ানো জলে যাঁহাদের কেহ কোথাও নাই তাঁহাদের তর্পণ করা হয় মন্ত্রে বাংলায় যার অর্থ এই দাঁড়ায় —‘যাঁহারা আমাদের বংশে জন্মিয়া পুত্রহীন ও বংশহীন হইয়া গত হইয়াছেন, তাঁহারা আমার এই  বস্ত্র-নিংড়ানো জলে তৃপ্ত হউনএরপর ওঁ নমঃ পিতা-স্বর্গঃ পিতা-ধর্ম্মঃ...মন্ত্রে করা হয় পিতৃস্তুতি
যার অর্থ... পিতাই স্বর্গ, পিতাই ধর্ম্ম, পিতাই পরম তপস্যা অর্থাৎ পিতা সেবাই তপস্যা, পিতা প্রসন্ন হইলে সকল দেবতাই প্রীত হন ও পিতৃপ্রণাম করা হয় যে মন্ত্রে তার অর্থ এই যে যাঁহারা স্বর্গে মূর্ত্তি ধারণ করিয়া বিরাজ করিতেছেন, যাঁহারা শ্রাদ্ধান্ন ভোজন করেন, অভীষ্ট-ফলের কামনা করিলে যাঁহারা সকল বাঞ্ছিত-ফল দান করিতে সমর্থ এবং কোন ফলের কামনা না করিলে যাঁহারা মুক্তি প্রদান করেন , সেই পিতৃগণকে প্রণাম করিসূর্য্যদেবের উদ্দেশে  পূর্ব্বদিকে মুখ করে ওঁ নমো বিবস্বতে ব্রহ্মণ, ভাস্বতে... মন্ত্রে জল দেয়া হয় তারপর  অর্থাৎ  হে পরম ব্রহ্মস্বরূপ সবিত্রিদেব ! আপনি তেজস্বী, দীপ্তিমান ; বিশ্বব্যাপী তেজের আধার, জগতের কর্ত্তা, পবিত্র, কর্ম্মপ্রবর্ত্তক; আপনাকে প্রণাম করি। ওঁ নমঃ জবাকুসুম-সংঙ্কাশং, কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং... মন্ত্রে প্রণাম জানাই সূর্য্যকে যার অর্থজবাফুলের ন্যায় রক্তবর্ণ, কশ্যপের পুত্র, অতিশয় দীপ্তশালী, তমোনাশী, সর্ব্বপাপ নাশকারী দিবাকরকে প্রণাম করি।সর্বশেষে অচ্ছিদ্রাবধারণ,বৈগুণ্য-সমাধান ও জপের দ্বারা আমরা তর্পণের সমাপ্তি করে থাকি
পরিশেষে এতটুকুই বলা যায় যে তর্পণ, পূর্বপুরুষ দের সাথে পরবর্তী প্রজম্মের এক পরিচয় পর্ব অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা যেতে পারেযার মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ দের স্মরণ করতে পারি, যাদের করুণায় আমাদের এই মানবদেহ অর্জন, তাঁদের প্রতি আমরা এই সামান্য জল ও তিলের দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রদান করে থাকি। এই তিল-জল দানে তাঁদের কতটুকু তৃপ্তি লাভ হয় সেটা হয়তো অনেকের কাছে তর্কের বিষয়, কিন্তু আমাদের মনের কোনে হয়তো বা এই আচার কিছুটা তৃপ্তি বোধ আনে বা এনে দিতে পারেআজকালের এই লুপ্তপ্রায় আচার-অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে এই পিতৃ পক্ষে কিছু সংখ্যক মানুষের তর্পণের আগ্রহ দেখে মনে হয় যে আমাদের কাছে আমদেরই পূর্বজের অনুষ্ঠিত কিছু আচার অনুষ্ঠান এখনও সমাদৃত আছে। তবে তা কতদিন থাকবে সেটাই বিচার্য। তর্ক-যুক্তির প্রভাবে এই  অনুষ্ঠান ও কোনদিন হারিয়ে যাবে আমাদের সমাজ থেকে।
       মা ভগবতী সবার মঙ্গল করুন। সবাই সুখে থাকুন... জয় মা।


তথ্যসুত্রঃ তর্পণ বিধি- শ্রীযুক্ত শশধর ভট্টাচার্য। 

No comments:

Post a Comment

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...