Saturday 22 October 2016

শিবলিঙ্গ-তথ্যের আধারে

শিবলিঙ্গ-তথ্যের আধারে                             
               শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী


নমস্কার,সবাই কে জানাই আমার আন্তরিক শারদ শুভেচ্ছা। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার এই অদম্য সাহসের জন্যে, আমি শাস্ত্র সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, বাংলা ভাষাতেও আমার জ্ঞান খুবই সীমিত তাই ভুলত্রুটি আপনারা নিজগুণে মার্জনা করবেন। আমি এবার শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে অনেকের মধ্যে যে ভুল ধারণা আছে তা দূর করার সামান্য চেষ্টা করছি।
কিছু সংখ্যক অজ্ঞ ও ভ্রান্ত মানুষেরা পরম পবিত্র শিবলিঙ্গ কে জননাঙ্গ ভেবে যা নয় তাই প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই শিবলিঙ্গ’ বলতে পুরুষাঙ্গ বিশেষ মনে করেন-কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। একথা সহজেই অনুমান করা যায় যেনিরাকার পরমাত্মার পুরুষাঙ্গ থাকতে পারে না। তাছাড়া পুরুষাঙ্গের সংস্কৃত প্রতিশব্দ শিশ্ন। আর লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ প্রতীক’ বা চিহ্ন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পাশ্চাত্য গবেষকরা লিঙ্গ ও যোনি কে, নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।ব্রিটিশরা মনে করত,শিবলিঙ্গ পুরুষ যৌনাঙ্গের আদলে তৈরি ও শিবলিঙ্গের পূজা ভক্তদের মধ্যে কামুকতা বৃদ্ধি করে। আমরা সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, আমাদের পুরনো তথ্য বিনষ্ট হওয়ার ফলে আজ আমরা প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।  সবচাইতে বড় কথা হল আমরা প্রত্যেক সংস্কৃত শব্দের সঠিক রুপান্তর ইংলিশ ভাষায় করতে পারছি না। যার ফলে অনেক সময় মুল বক্তব্য থেকে সঠিক তথ্য অনেক দূরে সরে যায়।লিঙ্গের মুখ্য অর্থ আলয়,  ইন্দ্রিয় বিশেষ কে  লিঙ্গ বলা হয় না।  সর্বভূত যেখানে লয়প্রাপ্ত হয় তাহাই আলয়। যেমন সমুদ্র থেকে সৃষ্ট বুদবুদ জলের উপরে এসে আবার জলেই মিশে যায় ঠিক সেইরূপ এই ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তু অনন্ত শূন্য থেকে জন্ম নিয়ে আবার তাতেই বিলয় হওয়ার জন্যে তাঁকে লিঙ্গ বলা হয়।  লীনং বা গচ্ছতি,লয়ং বা গচ্ছতি ইতি লিঙ্গম্” যা লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গ।আবার কারো মতে সর্ববস্তু যে আধারে লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গম। এই কারনেই তাকে বিভিন্ন নামে সম্বোধিত করা হয়ে থাকে যেমন প্রকাশ স্তম্ভ/লিঙ্গঅগ্নি স্তম্ভ/লিঙ্গশক্তি স্তম্ভ/লিঙ্গ ইত্যাদি কিন্তু বৈয়াকরণিকগণের মতে লিঙ্গতে চিহ্নতে মনেনেতি লিঙ্গম্”| লিঙ্গ শব্দের অর্থ প্রতীক’ বা চিহ্ন’| যার দ্বারা বস্তু চিহ্নিত হয়সত্য পরিচয় ঘটে তাই-ই লিঙ্গ। অর্থাৎ যার দ্বারা সত্যবিজ্ঞান লাভ হয়যার সাহায্যে বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায় তাকেই বস্তু পরিচয়ের চিহ্ন বা লিঙ্গ বলে। আর এজন্যই দেহ প্রকৃতিতে লীনভাবে অবস্থান করে বলেই চিদ্ জ্যোতিকে বলা হয় লিঙ্গ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে লিঙ্গ একটি সংস্কৃত শব্দ যা শুন্য,আকাশঅনন্ত ব্রহ্মাণ্ড ও নিরাকার পুরুষের প্রতীক। উপনিষদে সুক্ষ্ম দেহের বর্ণনায় বলা হয়েছে ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ’ শিব আমাদের হৃদয় মধ্যে অঙ্গুষ্ঠ পরিমান স্থানে আছেন, শিবপুরাণ ও অন্যান্য সকল শাস্ত্রেই শিবলিঙ্গ’ বলতে পরমব্রহ্মের প্রতীক’-ই বোঝানো হয়েছে। স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে  ‘আকাশং লিঙ্গমিত্যাহুঃ পৃথিবী তস্য পীঠিকা। প্রলয়ে সর্বদেবানাং লয়নাল্লিলিঙ্গমুচ্যতে।।’আকাশ স্বয়ং লিঙ্গধরণী তাঁর পীঠ বা আধার। প্রলয়কালে দেবতা সকল লয় প্রাপ্ত হলে একমাত্র লিঙ্গ রূপী শিবই বর্তমান ছিলেন। সেইকারণে লিঙ্গ শব্দে একমাত্র মহাদেবকেই বোঝায়। একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ীশিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।হিন্দুরা শিবলিঙ্গকে সৃষ্টির পিছনে নারী ও পুরুষ উভয়ের যে অবদান তার কথা স্মরণ করে  শিবলিঙ্গের পূজা করেন শিবলিঙ্গে যে যোনি চিহ্ন দেখা যায়  তাকে গৌরীপট্ট বা গৌরী পীঠ বলে।এই গৌরীপট্ট বা গৌরী পীঠ হল মহাশক্তির প্রতীক। শিবলিঙ্গ ও যোনি র এই সম্মিলিত রূপটিকে "নারী ও পুরুষের অবিচ্ছেদ্য ঐক্যসত্ত্বা এবং জীবনসৃষ্টির উৎস পরোক্ষ স্থান ও প্রত্যক্ষ কালের প্রতীক" হিসেবে গণ্য করা হয়।পুরো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যে অক্ষের উপর ঘুরচ্ছে সেটাই লিঙ্গ... শিব লিঙ্গ। আক্ষরিক বিশ্লেষণে দেখা যায়- শিব’ শব্দের অর্থ মঙ্গল’ আর লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। শাস্ত্র শিব’ বলতে নিরাকার সর্বব্যাপি পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মকেই বোঝায়। তাই শিবলিঙ্গ’ হচ্ছে মঙ্গলময় পরমাত্মার প্রতীক। শিবপুরাণ অনুসারে ভগবান শিবই একমাত্র ব্রহ্মরূপ হওয়ায় তাঁকে নিরাকার বলা হয়। যেহেতু তিনি সর্বশক্তিমান’ তাই তিনি জগতকল্যাণের জন্য রূপধারণও করতে পারেন। রূপবান হওয়ায় তাঁকে সাকার বলা হয়। তাই তিনি সাকার ও নিরাকার-দুইই। শিব সাকার ও নিরাকার হওয়ায় তাঁর পূজার আধারভূত লিঙ্গও নিরাকার অর্থাৎ শিবলিঙ্গ  শিবের নিরাকার স্বরূপের প্রতীক। তেমনই শিব সাকার হওয়ায় তাঁর পূজার আধারভূত বিগ্রহ সাকাররূপ। শিব ব্যতীত অন্য যেসকল দেবতা আছেনতাঁরা সাক্ষাৎ ব্রহ্ম ননতাই কোথাও তাঁদের নিরাকার লিঙ্গ দেখা যায় না। লিঙ্গ সাক্ষাৎ ব্রহ্মের প্রতীক। স্বামী বিবেকানন্দ প্যরিসে হয়ে যাওয়া ধর্মসমূহের ঐতিহাসিক মূল শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্ববাসীর সামনে অথর্ববেদের স্কম্ভসুক্তের সাহায্যে তুলে ধরেন যে শিবলিঙ্গ মূলত বিশ্বব্রহ্মান্ডেরই প্রতীক। আমরা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনায় পাই যে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ ধারণা থেকে। যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ হল বলিদানের হাঁড়িকাঠ।এটিকে অনন্ত ব্রহ্মের একটি প্রতীক মনে করা হত। জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করে তা পাঠ করলেতারই প্রতিক্রিয়ায় বিবেকানন্দ এই কথা বলেছিলেন।বিবেকানন্দ বলেছিলেনশালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। শিবলিঙ্গর সঙ্গে পুরুষাঙ্গের যোগ বৌদ্ধধর্মের পতনের পর আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত গল্প। স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী ও বলেন, "এটি শুধু ভুলই নয়বরং অন্ধ অভিযোগও বটে যে শিবলিঙ্গ পুরুষলিঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী"। এমনি আরও অনেক জ্ঞানী,গুণী,সাধু-সন্ত ও মহাপুরুষেরা শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা নির্মূলের স্বপক্ষে অনেক মাতবাদ প্রকাশ করেছেন, স্বল্প পরিসরে তার বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলা যেতে পারে যে আমাদের নিজেদের অজ্ঞতাকে আড়াল করতে গিয়ে ও ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে এমন কোন আচরণ বা মন্তব্য করা উচিত নয় যা সমাজে সকল শ্রেণী, সকল জাতির কাছে আমাদের এই মহান ধর্ম এক হাস্যকর বিষয় হয়ে উঠে। আমাদের সকলের কর্তব্য কোন বিষয়ে মন্তব্য করার আগে সেই বিষয় টিকে সঠিক ভাবে জেনে নেওয়া আর আমরা যতটুকু সঠিক জানি তা সকলের মধ্যে বিলিয়ে  দেওয়া যাতে অন্যরাও তাঁদের ভ্রান্ত ধারণা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে ও মিথ্যে সমালোচক দের যোগ্য জবাব দিতে পারে। সবচাইতে গুরুত্ব পূর্ণ হল বর্তমান প্রজন্মের কাছে এইসকল তথ্য তুলে ধরা যাতে তারাও কোন ভুল ধারনার শিকার হয়ে নিজ ধর্মকে অবহেলা করতে শুরু না করে, বরঞ্চ গর্বের সাথে নিজ ধর্মের মহানতা সকলের কাছে  প্রকাশ করতে পারে। বিভিন্ন সূত্রের সাহায্যে এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করা ও সকলের কাছে তা প্রকাশ করার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস তখনই সার্থক মনে হবে যখন সমাজ থেকে এই বিষয় সম্বন্ধে ভুল ধারণার অবসান ঘটবে।
জগন্মাতা দেবী দুর্গার কাছে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সদবুদ্ধির প্রার্থনা জানাই।
                                      জয় শিব-শম্ভু... জয় মা দুর্গা। 

সুত্রঃ শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, স্বামীজীর বাণী ও রচনা, তন্ত্র রশ্মি ১ম খণ্ড, "Worship of Siva Linga" by Swami Sivananda Saraswati ইত্যাদি

No comments:

Post a Comment

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...