Tuesday 21 June 2016

অম্বুবাচী





আমাদের হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন  আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া,ধর্মকৃত্য বা লৌকিক আচার,বিভিন্ন ব্রত। অম্বুবাচী ঠিক তেমনি একটি লৌকিক আচার।সেই অম্বুবাচী নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকরই মনে অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহল জাগে। কি সেই অম্বুবাচী? বিভিন্ন অঞ্চলে লোকেরা অম্বুবাচী কে অমাবতি নামেও জানে। হিন্দু শাস্ত্রে পৃথিবীকে মাতৃভাবে ধারনা করা হয়। বেদ ও অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। মা যেরূপ সন্তান দের জন্মদান করে নিজের স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা সন্তানের আহার যোগায়, ঠিক তেমনি পৃথিবীর বুকে ও অসংখ্য জীবজন্তু, গাছপালা জন্মাচ্ছে গ্রহন করছে জল-বায়ু-আহার এই পৃথিবীর বুক থেকেই। হয়তো সেই ধারণা থেকেই যুগযুগ ধরে পৃথিবী কে মা হিসেবে গন্য করা হয়ে আসছে।
সূর্য যেসময় মিথুন রাশির আদ্রা নক্ষত্রে প্রবেশ করেন সেইদিন থেকে সূচনা হয় বর্ষা কালের এবং সূর্যের আদ্রা নক্ষত্রে প্রথম পাদে অর্থাৎ এক চতুর্থাংশে (৩˚।২০´) অবস্থান কালকে অম্বুবাচীর সময় বলে ধরা হয়। মেয়েদের ঋতুকালে রজঃস্বলা হয় ও একজন নারীর ঋতুকাল শেষের পরেই সন্তান ধারণে সমর্থ হন। ঠিক তেমনি ধারণা করা হয় যে প্রতিবছর সূর্যের এই আদ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদে অবস্থান কালে ধরণী মাতা ঋতুমতী হন এবং সেই সময়ে অম্বুবাচী পালিত হয়।  এই আচারের সাথে প্রাচীন কৃষি ব্যাবস্থার একটা সুসম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। আষাঢ় মাসের আরম্ভেতে বসুমতি মাতা যখন বর্ষার নতুন জলে সিক্ত হয়ে ওঠেন তখন তাকে এক  ঋতুমতি নারী রূপেই গণ্য করা হয় এবং তখন অম্বুবাচীর প্রবৃত্তি বা শুরু হয়, আবার তার ঠিক তিন দিন পরে সেটা নিবৃত্তি বা শেষ হয়। এই নিবৃত্তির পরই প্রাচীন কালে জমি চাষ শুরু করত কৃষকেরা। আজ ও  বিভিন্ন এলাকায়  এই নিয়ম পালন করা হয়। এই তিন দিন জমিতে কোন চাষবাস করা হয় না। নতুন বর্ষার জলে পৃথিবীর মাটি হয়ে উঠে নরম ও নতুন বছরে  নতুন ফসল উত্পাদনের উপযোগী হয়ে উঠে। ভারতের কোন কোন অঞ্চলে এই সময়কে রজোৎসব নামেও পালিত করা হয়। আসামের কামরূপের কামাখ্যা পাহাড়ে যেখানে দেবী মহামায়ার যোনি পরেছিল সেই স্থানে অবস্থিত দেবী কামাখ্যামন্দিরের দরজা  অম্বুবাচীর এই তিনদিন বন্ধ থাকে, চলে অম্বুবাচী মেলা। এইসময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সাধু, সন্ন্যাসী ও ধার্মিক ব্যাক্তিরা এসে কামাখ্যা পাহাড়ে মিলিত হন। অম্বুবাচী নিবৃত্তির পরই খুলে দেবী মার মন্দিরের দরজা, অনুষ্ঠিত হয় মায়ের বিশেষ পূজা। এই বিশেষ মেলা পর্যটক ও দর্শনার্থী দেরও বিশেষ ভাবে আকর্ষিত করে এবং প্রতিবছরই এইসময়ে কামাখ্যা পাহাড়ে উপচে পড়ে অসংখ্য জনগণ।

প্রচলিত প্রথা অনুসারে ঋতুকালে মেয়েরা যেমন অশুচি থাকে ও সেই কারনে  কোন মাঙ্গলিক কর্ম থেকে তারা বিরত থাকেন, ঠিক একইরূপে বসুমাতা অম্বুবাচীর এই  তিন দিন অশুচি থাকেন বলে ধারনা করা হয়। এ সময়ে  ব্রহ্মচারী, সাধু,সন্ন্যাসী, যোগীপুরুষ, বিধবা মহিলারা কেউই আগুনের রান্না করা কিছু খান না, তার কারন হলো যেহেতু বসুমাতা ঋতুমতী সেইহেতু সেই সময় পৃথিবীর বুকে আগুন ধরানো হয় না। সেই সময় তারা নানাপ্রকার ফলমূল  ও কাঁচা দুধ খেয়ে থাকেন। যদিও এটা একটা লৌকিক আচার তবুও এই আচারের মাধ্যমে সমাজের জীবনব্যবস্থার একটি উন্নত ও  সুস্থ চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। 
নুতন সংযোজন
অম্বুবাচী বা অমাবতী এ কিন্তু সম্পুর্ন লোকাচার, এই সময়ের বিধি নিষেধ আমাদের শাস্ত্রে বর্ণিত নেই। আমাদের সনাতন শাস্ত্রে পৃথিবীকে মা বলা হয়ে থাকে। বেদেও একই রকমই তাকে মা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, আবার পৌরানিক যুগেও পৃথিবীকে ধরিত্রী মাতা বলা সম্বোধন করা হয়েছে।সেই লোকাচার অনুযায়ী মতে আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে পৃথিবী ঋতুমতী হন। মহাজাগতিক ধারা অনুযায়ী পৃথিবী যখন সূর্যের মিথুন রাশিস্থ আদ্রা নক্ষত্রে অবস্থান করে সেদিন থেকে বর্ষাকাল শুরু ধরা হয়। পাশাপাশি আমরা জানি মেয়েদের ঋতুকাল বা রজঃস্বলা হয় এবং একজন নারী তারপরই সন্তান ধারনে সক্ষম হয় ।ঠিক তেমনি প্রতিবছর অম্বুবাচীর এই তিনদিনকে পৃথিবীর ঋতুকাল হিসেবে ধরা হয়।এরসঙ্গে প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থা জড়িয়ে থাকায় এটির একটি সামাজিক প্রভাবও রয়েছে।তাই অম্বুবাচী’ একটি কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান হিসেবেই ধরা হয়। এই সময় ধরিত্রীর ঊর্বরাকাল।দেখা যায় এই তিন দিন জমিতে কোনও রকম চাষ করা হয় না যাতে বর্ষায় সিক্তা হয়ে পৃথিবী আবার নতুন বছরে নতুন ফসল উত্পাদনের উপযোগী হয়ে ওঠেন। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী ঋতুকালে মেয়েরা অশুচি থাকে,শরীরে যাতে কোন আঘাত না লাগে তার ব্যাবস্থা নেওয়া হয় । ঠিক একই ভাবে পৃথিবীও এই অম্বুবাচী বা অমাবতির তিন দিন অশুচি থাকেন বলে চাষিরা আর মাঠে যান না হাল টানতে, বা কোন প্রকার মাটি কোপানো নিষিদ্ধ। এমন ও শোনা যায় এই সময় কালে পিঁপড়ে, উইপোকাও মাটি খোঁড়ে না সেই সময় কালে এখন ও বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ম রক্ষা হয়।ওড়িশাতে এটি ‘রজ উৎসব’ নামে পালিত হয়। এই সময়ে কৃষকেরা ছুটি পালন করেন। মেয়েদের কৃষি ও গৃহকর্ম থেকে পুরোপুরি বিরত রাখা হয়। অম্বুবাচীর দিনগুলি তাঁদের কাছে বিশ্রামের দিন। এই সময়ে তাঁরা নতুন জামা-কাপড় পরেন। সিঁদুর-আলতায় সুসজ্জিত হন।‘মিথুন সংক্রান্তি’ বা ‘রজ পর্ব’ নামে পরিচিত এই উৎসবও তিন দিন ধরে পালিত হয়। তিন দিনের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘পহিলি রজো’। দ্বিতীয় দিন থেকে মিথুন মাস শুরু হয়। অর্থাৎ, বর্ষার প্রারম্ভ হয়। পুরাণ মতে, ভূদেবী এই সময় রজঃস্বলা হন। তৃতীয় দিনটি হল ‘ভূ দহ’ বা ‘বাসি রজো’। চতুর্থ দিনে বসুমতী স্নান। অর্থাৎ, ধরিত্রী মা বা ভূদেবীর স্নান। ভূদেবী হলেন জগন্নাথের স্ত্রী। পুরীর মন্দিরেও জগন্নাথের পাশে রূপোর ভূদেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এই সময় শুধু মাত্র বিধবারাই নয় যারা ব্রহ্মচর্য পালন করেন যেমন: ব্রহ্মচারী ,সাধু ,সন্ন্যাসী ,যোগীপুরুষ ,বিধবা মহিলা তাঁরা কেউই কোনও ভাবে আমিষ খাদ্য গ্রহণ করেন না নিরামিষ খেয়ে থাকেন৷ যেহেতু এরা কেউই অশুচি পৃথিবীর উপর আগুনের রান্না করা কিছু খান না।এই সময় আগুনের আঁচে গরম করা কোনও খাবার তাঁরা খান না। আবার কোথাও কোথাও সূর্যের তাপে খাবার গরম করে নেওয়ার প্রথাও প্রচলিত আছে। বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে এই তিন দিন কাটান। এই কারণে এখনও পরিবারে বয়স্ক বিধবা মহিলাদের তিনদিন ধরে অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে সেই নিয়ম পালন করতে দেখা যায়৷

1 comment:

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...