Thursday 17 November 2022

কার্তিক পূজা

 জ কার্তিক পূজা যদিও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে অনেক স্থানে, আমার জানা কিছু তথ্য তুলে ধরলাম আপনাদের কাছে...... ভুলভ্রান্তি ক্ষমাকরে দেবেন...




কার্ত্তিক দেবতার ধ্যান :
ওঁ কার্ত্তিকেয়ং মহাভাগং ময়ুরোপরিসংস্থিতম্। তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং শক্তিহস্তং বরপ্রদম্।। দ্বিভুজং শক্রহন্তারং নানালঙ্কারভূষিতম্। প্রসন্নবদনং দেবং কুমারং পুত্রদায়কম্।।
প্রণামঃ-
ওঁ কার্ত্তিকের মহাভাগ দৈত্যদর্পনিসূদন। প্রণোতোহং মহাবাহো নমস্তে শিখিবাহন। রুদ্রপুত্র নমস্ত্তভ্যং শক্তিহস্ত বরপ্রদ। ষান্মাতুর মহাভাগ তারকান্তকর প্রভো। মহাতপস্বী ভগবান্ পিতুর্মাতুঃ প্রিয় সদা। দেবানাং যজ্ঞরক্ষার্থং জাতস্ত্বং গিরিশিখরে। শৈলাত্মজায়াং ভবতে তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ।
অনুবাদ : হে মহাভাগ, দৈত্যদলনকারী কার্ত্তিক দেব তোমায় প্রণাম করি। হে মহাবাহু, ময়ূর বাহন, তোমাকে নমস্কার। হে রুদ্রের (শিব) পুত্র, শক্তি নামক অস্ত্র তোমার হাতে। তুমি বর প্রদান কর। ছয়। কৃত্তিকা তোমার ধাত্রীমাতা। জনক-জননী প্রিয় হে মহাভাগ, হে ভগবান, তারকাসুর বিনাশক, হে মহাতপস্বী প্রভু তোমাকে প্রণাম। দেবতাদের যজ্ঞ রক্ষার জন্য পর্তবতের চূড়ায় তুমি জন্মগ্রহণ করেছ। হে পর্বতী দেবীর পুত্র তোমাকে সতত প্রণাম করি।
কার্তিক পূজা হিন্দুদের একটি অন্যতম পুজা। কার্তিক হলেন হিন্দু্দের যুদ্ধদেবতা। দেবাদিদেব মহাদেব শিব ও দশভুজা দুর্গার আদরের ছোট পুত্র কার্তিক। গণেশ তাঁর দাদা। তবে কোনও কোনও পুরাণে কার্তিককে আবার বড় এবং গণেশকে ছোট পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিয়ে নানা মতপার্থক্যও আছে। কার্তিক বৈদিক দেবতা নন; তিনি পৌরাণিক দেবতা। দুর্গাপুজোর কিছু সময় পরেই অর্থাৎ কার্তিকমাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকের পুজো।
ব্রহ্মার বরে মহাবলী তারকাসুরের নিধনের জন্যই নাকি অমিত বিক্রম যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। তারকাসুরকে বধের জন্য তার জন্ম হয়েছিল। পরমেশ্বর শিব ও পরমেশ্বরী পার্বতীর যোগের মাধ্যমে আত্ম মিলন হয়।ফলে এক অগ্নিপিণ্ডের সৃষ্টি হয়। রতির অভিশাপের সম্মান রক্ষার্থে গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি মা পার্বতী।তাছাড়া ঈশ্বর কখনও মনুষ্যের ন্যায় সন্তান জন্ম দেন না। অগ্নিদেব সেই উৎপন্ন হওয়া নব্য তেজময় জ্যোতিপিন্ড নিয়ে পালিয়ে যান।ফলে মা পার্বতী যোগ ধ্যান সমাপ্তি হতেই ক্রুদ্ধ হন।অগ্নিদেব ঐ অগ্নিপিণ্ডের তাপ সহ্য করতে না পেরে গঙ্গায় তা নিক্ষেপ করে। সেই তেজ গঙ্গা দ্বারা বাহিত হয় ও সরবনে গিয়ে এক রূপ বান শিশুর জন্ম দেয়। জন্মের পর কুমার কে কৃতিকা গণ স্তন্য পান করালে তিনি কার্তিক নামে অভিহিত হন ।পরে দেবী পার্বতী শিশু স্কন্দ কে কৈলাসে নিয়ে আসেন।
পুরাণ অনুসারে কার্তিক গায়ের রঙ হলুদবর্ণের আর তিনি চিরকুমার। তবে পুরাণ মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বিবাহের উল্লেখও পাওয়া গেছে। কার্তিকের বাহন ময়ূর।সৌন্দর্য এবং শৌর্য এই দুটি বৈশিষ্ট্যই ময়ূরের মধ্যে বিদ্যমান। কার্তিকের ছয়টি মাথা।তাই তিনি ষড়ানন। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক।
কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম(কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ(লালসা),মদ(অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন।পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করেন ।
কেউ বধ করতে পারছিলনা তারকাসুরকে। তার অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ঠ।আর দৈববলে অজেয় শক্তি সম্পন্ন এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেছিলেন । আর এই তারকাসুর নিধন করে দেবকুলে কার্তিক গেলেন দেবসেনাপতি। তাই কার্তিকের পুজো হয় মহাসমারোহে। দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।
কোথাও খ্যাতি ‘স্কন্দ’ নামে, কোথাও বা ‘মুরুগন’ আবার কেউ তাকে ডাকে ‘সুব্রহ্মণ্য’ নামে। প্রকৃতপক্ষে তিনি দেব সেনাপতি, যুদ্ধের দেবতা ও আমাদের ঘরে ঘরে পরম পূজনীয় কার্তিকেয় বা কার্তিক, যিনি পুরুষ শিব ও আদি পরাশক্তি পার্বতীর পুত্ররূপে সু প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই দেবলোকে যেখানেই যুদ্ধ হয় সেখানেই কার্তিকের ডাক পড়ে।
অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মতো কার্তিকেরও একাধিক নাম আছে, যেমন কৃত্তিকাসুত, আম্বিকেয়, নমুচি, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুলেয়, ক্রৌঞ্চারতি, শরজ, তারকারি, শক্তিপাণি, বিশাখ, ষড়ানন, গুহ, ষান্মাতুর, কুমার, সৌরসেন, দেবসেনাপতি গৌরী সুত ইত্যাদি।
যদিও পুরাণ্মতে দেবসেনাপতি কার্তিক চিরকুমার কিন্তু আবার কিছু কিছু পুরাণ অনুসারে ভগবান কার্তিকের স্ত্রী হলেন দেবসেনা ও বালি(বল্লী)। সুরাপদ্মনকে বধ করার পর দেবরাজ ইন্দ্র নিজ কন‍্যা দেবসেনার সঙ্গে কার্তিকের বিয়ে দেন। পরে নম্বিরাজের কন্যা বালি-র সঙ্গে কার্তিকের বিবাহ হয়।
কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে ছয় সংখ্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আর সেই কারণেই হয়ত ষষ্ঠীর সাথে তার মিল৷ যতক্ষণ না বাচ্চা বড় হচ্ছে ততদিন অবধি তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন ৷কথিত আছে কার্তিক ঠাকুরের কৃপা পেলে সন্তানলাভ এবং ধনলাভ হয়। সেজন্য সদ্য বিয়ে হয়েছে অথবা বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে অথচ এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয় এই বিশ্বাসে যে এতে নিঃসন্তানের ঘরে সন্তান জন্ম নেবে। এটি একটি জনপ্রিয় লোকাচারের মধ্যে পড়ে ।
পূর্ববঙ্গে সন্তানবতী মায়েরা পালন করতেন এই ব্রত; এখনও এপার-ওপার বাংলার বহু নারী এই ব্রত করেন কার্তিক সংক্রান্তিতে। ব্রতের প্রধান অঙ্গ কার্তিকের প্রতিমা পুজো। সায়ংকালে শুরু হয় পুজো — চার প্রহরে চারবার পুজো আর কথা শ্রবণ; অশক্ত হলে একবারই পুজো এবং প্রাতঃকালে বিসর্জন, যদিও পূর্ববঙ্গে প্রতিমা জলে দেওয়ার নিয়ম নেই। লোকমানসে মূলত সন্তান কামনায়, বিশেষত পুত্র সন্তান কামনায় বন্ধ্যা নারীরা ভক্তিভরে এই দেবতার পুজো করেন। কার্তিকের একাধিক মূর্তি পূজিত হয়। পুজোর শেষে সন্তানহীনা নারী এক-একটি কার্তিক মূর্তি কোলে নিয়ে ঘরে খিল এঁটে দেয়। অনেক সময় সংক্রান্তির আগের রাতে পাড়ার অত্যুত্‍সাহী যুবকেরা নৈশ গোপনতায় নবদম্পতির দুয়ারে কার্তিকের মূর্তি রেখে আসে; উদ্দেশ্য অপুত্রক দম্পতিকে কার্তিক পুজোয় বাধ্য করানো। শুদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে দেখা যায় কার্তিক ‘চোরের দেবতা’ ইমেজে পূজিত হচ্ছেন। ‘কথাসরিতসাগর’-এর কার্তিকও চোরের দেবতারূপে চিহ্নিত। লোকবিশ্বাস, কার্তিক সিঁধ কাটার বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্ভাবক। বাংলার অনেক অঞ্চলে বারবণিতাদের হাত ধরে কার্তিক পুজোর প্রচলন হয়েছে।
এই কার্তিক পুজোর মনস্তাত্ত্বিক কারণ তিনটি– প্রথম, ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’ — এরকম একটা হৃদয়ের ব্যাকুলতা; দ্বিতীয়, অনাস্বাদিত মাতৃত্বের স্বাদ মেটাতে ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’র প্রচেষ্টা। তৃতীয়, কার্তিককে ভ্রূণের দেবতারূপে মান্যতা দেওয়া। আকস্মিক ভ্রূণ উত্‍পাদন বন্ধ করতে বারবণিতারা কার্তিক পুজো করেন। লোকসমাজে কার্তিক শস্য দেবতাদের অন্যতম। তাই বাংলার অনেক অঞ্চলে কৃষি দেবতাকে এইদিন পুজো করা হয়। সারারাত ধরে গাওয়া হয় গান। ফসলের কীটশত্রু, জীবজন্তু তাড়িয়ে দেওয়াই গানের মূল বিষয়। পুজোর পর মূর্তিটি বিসর্জন না দিয়ে শস্যক্ষেত্রে রেখে দেওয়া হয় শস্য রক্ষাকর্তা হিসাবে। কার্তিক ব্রতে কার্তিক প্রতিমার পাশে রাখা হয় ‘হালা’। হালা হচ্ছে মাটির সরায় মাটিতে লাগানো নানান শস্য চারা। সম্ভবত কার্তিক কৃষি দেবতা বলেই এই সরার শস্যক্ষেত্র। অনেক সময় উঠোনে মন্ডল করে তার চারপাশে চারা তৈরি করেও মাঝখানে কার্তিক প্রতিমা রাখা হয়। পুজোর ঘট ছাড়াও প্রতিমার সামনে কতকগুলো ছোটো ঘট রেখে তাতে চাল ও ফল দেওয়া হয়।

No comments:

Post a Comment

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...