Monday, 7 November 2022

শুভ রাসপূর্ণিমা


 

সকল কে জানাই শুভ রাসপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা......

 আমরা অনেকেই জানি না রাস শব্দের অর্থ। ঈশ্বরের সাথে আত্মার মহামিলনকেই রাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রস' শব্দ থেকে 'রাস'-এর উৎপত্তি। মূলত কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে 'রাস'-এর ক্ষণ। 'রস' মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। হিন্দুশাস্ত্রে কথিত আছে রাস পূর্ণিমাতেই কৃষ্ণলীলা করেন। তাই রাস পূর্ণিমাতেই পালিত হয় রাস-লীলা। এই দিনটি বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের লীলা করার দিন। 'লীলা' মানে নৃত্য।'রাসলীলা'- যে নৃত্য পরিবেশিত হয় তার নাম 'রাস-নৃত্য' এটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত, যথাক্রমে-- মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিব্যরাস, নিত্যরাস। প্রেমরসের এই পঞ্চলীলায় সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ মহারাস-এ। এই পর্যায়েই রয়েছে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা- অভিসার, গোষ্ঠী অভিসার, গোপীগণের রা-আলাপ,কৃষ্ণ নর্তন, রাধানর্তন, গোপীদের নর্তন, শ্রীকৃষ্ণের অন্তর্ধান-প্রত্যাবর্তন, পুষ্পাঞ্জলি, গৃহগমণ।

'চিরহরণ'-এর গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃ্ষ্ণের এই লীলা। কথিত আছে গোপীরা নাকি এই দিনটিতে অপেক্ষা করেন কৃষ্ণের ডাকের জন্য। কতক্ষণে তাঁদের প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণ লীলা- জন্য ডাক দেবেন  তা শোনার জন্য নাকি উন্মুখ হয়ে থাকেন গোপীরা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারাণী   গোপীকাগণ কে নিয়ে বৃন্দাবনের রাগমন্ডলে  কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমায়  মহারাস লীলা করেছিলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা, মহাদেব শিব, স্বর্গরাজ ইন্দ্র, সমস্ত দেব-দেবী, গন্ধর্ব, অপ্সরা-কারও পক্ষে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধারাণীর রাসলীলায়  অনুপ্রবেশ সম্ভব ছিল না  ব্রহ্মা ষাট হাজার বছর তপস্যা করেও ভগবদহ্লাদিনী শক্তি ব্রজগোপিকাগণের রাসলীলা দর্শন করতে সক্ষম হননি।এমন কি বৈকুন্ঠের লহ্মীদেবীও শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলায় প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি, তাই তিনি যমুনার অপর পারে কৃষ্ণপাদপদ্ম ধ্যানেই উপবিষ্ট হয়ে থাকলেন মহাদেব শিবও  রাসলীলা দর্শনে গিয়ে বঞ্চিত হয়েছিলেন

যদিও, 'রাস-লীলা' নিয়ে বেশকিছু মত প্রচলিত আছে। এরমধ্যে বহুল জনপ্রিয় দু'টি মত। এই দুই মতেই কেন এই রাস-লীলা তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। কথিত আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচন পূর্ণলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। এই থেকেই শুরু হয় 'রাস মেলা' আবার অন্য মতালম্বীদের মতে, দুর্গাপুজোর পর পূর্ণিমাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে 'লীলা'- মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর সেই থেকেই এই পূর্ণিমাতে 'রাস-লীলা' পালিত হয়ে আসছে। কৃষ্ণপ্রেমে 'কাম'-কে জাগতিক ভাবনায় ভাবাটা অপরাধ

আমরা আমাদের শাস্ত্র সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, তাই বিভিন্ন  অপপ্রচারকারী দের বক্তব্যে বিশ্বাস করে রাস-লীলাকে বিকৃত রূপে ভাবতে শুরু করেছি। অপপ্রচারকারীরা অনায়াসে রাসলীলাকে বা রাস নৃত্যকে দৈহিক কাম ভাবনায় নৃত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় অনেকাংশে সফল হচ্ছে আমাদের নিজেদের শাস্ত্রের প্রতি উদাসীনতার কারণে।   রাসে দৈহিক কাম বাসনা জাগ্রত হয়,  তা কিন্তু মূলতঃ নয়। এখানে গোপীরা মানে সকল আত্মা যারা তাঁদের  পূণ্যবলে ভগবানের সাথে মিলিত হয়েছেন তাঁরা শ্রীমতি রাধারানী ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সাথে নৃত্যকীর্ত্তনে মেতে উঠেছিলেন।উল্লেখ্যঃ দৈহিক কামনা বাসনার দেবতা কামদেব যখন  রাস মন্ডলে এসে দৈহিক কাম ছড়াতে চেয়েছিল তখন ভগবান তাকে কদম গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন কারণ, পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলনে কোন কামনা বাসনা থাকে না, শুধু থাকে পবিত্র প্রেমভক্তি। রাস-লীলা- ব্যাখ্যায় কৃষ্ণের বংশীবাদনকে 'অনঙ্গ বর্দ্ধনম' বলা হয়েছে। কেউ যদি ভগবানের স্পর্শ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয় বা তাকে খাওয়াবার জন্য ব্যকুল হয় অথবা ভগবানের কাছ থেকে আনন্দ পেতে বা দিতে চায়, তাহলে তাকে বলে 'অনঙ্গ' এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল 'কাম' কিন্তু গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ককে এতটা সরলীকরণ করে ভাবাটা অপরাধ। বলা হয় গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম  আধ্যাত্মিকরূপে,জাগতিক রূপে  নয়। গোপীরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কৃষ্ণকে প্রেম নিবেদন করেন, এতে কোনও দ্বিধা,দ্বন্দ্ব রাখার অবকাশটুকু নেই । 

তাই আসুন আজ আমরা সকল ভুল-ভ্রান্তি ভুলে রাধাকৃষ্ণ ভাবে মেতে উঠি।

 

দেব-দীপাবলি

 

image curtsy: google image

শিবের নগরীতে আজ পালিত হচ্ছে দেব-দীপাবলি, যদিও নিয়ম অনুযায়ী আগামীকাল দেব-দীপাবলি কিন্তু আগামীকাল চন্দ্র-গ্রহণ থাকার কারনে আজ এই উৎসব পালিত হচ্ছে।

আসুন জেনে নেওয়া যাক কি এই দেব-দীপাবলি?
দীপাবলির ঠিক পনেরো দিন পরই পালিত হয় দেব দীপাবলি। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় দেব দীপাবলি পালিত হয়। কার্তিক পূর্ণিমাতেই হয় এই উৎসব। বিশেষতঃ বারাণসীতে গঙ্গায় আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয় এই উৎসব। সেই উপলক্ষে গোমতী ঘাট জুড়ে, রাতের গঙ্গায় ভাসানো হয় লক্ষ লক্ষ জ্বলন্ত প্রদীপ।মর্ত্যের নয়। এই উৎসব আসলে স্বর্গের দেবতাদের।কথিত আছে স্বর্গ থেকে এইদিন নাকি দেবতারা নেমে আসেন গঙ্গায় স্নান করতে। দেবতাদের দীপাবলির অংশ হয়ে উঠতেই সবাই এদিন গঙ্গা বক্ষে প্রদীপ ভাসিয়ে দিনটি পালন করেন।পূর্ণিমার চাঁদ দেখে নদীতে প্রদীপ ভাসানোই এই উৎসবের রীতি। দেবী গঙ্গা ও অন্যান্য দেবদেবীর উদ্দেশে গঙ্গার প্রায় প্রত্যেকটি ঘাটে জ্বালানো হয় অন্তত কয়েক লক্ষ প্রদীপ। কার্তিক পূর্ণিমায় সকালে উঠে গঙ্গাস্নান করে সন্ধ্যায় প্রদীপ ভাসানোর প্রথা এই দিনে।অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে ভগবান শিবের জয়কেই এই উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয়। ত্রিপুরাসুরকে মেরে জয়ী হয়েছিলেন শিব। তাই এই উৎসবকে ‘ত্রিপুরোৎসব’ ও বলা হয়।
বিশ্বাস অনুসারে যখন ভগবান কার্তিকেয় তারকাসুরকে বধ করেন, তখন তার তিন পুত্র দেবতাদের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তারাকাসুরের তিন পুত্র কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর প্রার্থনা করে, তাঁরা ব্রহ্মাকে বলে “হে প্রভু! আপনি আমাদের জন্য মহাশূন্যে তিনটি পুরী তৈরী করুন এবং অশ্বিনী ভরণীর সংযোগ ক্ষণে যখন এই তিনটি পুরী একই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সেইসময় কেউ যদি খুব শান্ত অবস্থায় তীরের সাহায্যে আমাদের হত্যা করার চেষ্টা করে তাহলেই যেন আমাদের মৃত্যু হয়। ব্রহ্মা তিনজনকেই তাঁদের ইচ্ছামত বর প্রদান করেন।এই বর পাওয়ার পর তাঁরা তিন অসুর তাঁদের আসুরিক শক্তি দ্বারা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমস্ত মানুষ ও দেবতাদের অত্যাচার করতে শুরু করে।এদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সকলে মিলে ভগবান শিবের কাছে সাহায্য চাইতে গেলেন এবং শিবকে অসুরদের সমূলে বিনাশের অনুরোধ করতে লাগলেন।সকল দেবতা ও মানুষের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ভগবান শিব, রাক্ষস ত্রিপুরাসুর সহ তিন অসুরদেরকে বধ করেন। ত্রিপুরাসুরের নিধনের আনন্দে সমস্ত দেবতারা প্রসন্ন হয়ে শিবের নগরী কাশীতে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেছিলেন। যেদিন এই সব ঘটেছিল সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথি, তারপর থেকে, কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সর্বত্র দেব দীপাবলি নামে একটি জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব পালিত হয়।
আবার অন্য মতানুসারে ত্রিশঙ্কুকে ঋষি বিশ্বামিত্র তাঁর তপস্যার দ্বারা স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতে দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়ে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন, ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র তাঁর দৃঢ়তায় স্বর্গ মর্ত্য থেকে এক পৃথক এক নতুন জগৎ সৃষ্টি শুরু করেন, তাঁর সাধনার বলের দ্বারা তিনি গাছ-পালা, মাটি, উট, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদি সৃষ্টি করলেন। এরই মধ্যে রাজর্ষি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশের মূর্তি তৈরি করে তাদের মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন এতে স্বর্গের সকল দেবতারা ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে প্রার্থনা করলে মহর্ষি খুশি হয়ে নতুন জগৎ সৃষ্টির সংকল্প ত্যাগ করেন। এরপর সকল দেবতারা প্রসন্ন হয়ে দীপাবলির মতোই ত্রিভুবনে উৎসব পালিত করেন, সেই থেকে এই দিন দেব দীপাবলি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এটিও বিশ্বাস করা হয় যে আষাঢ় শুক্লা একাদশী থেকে, ভগবান বিষ্ণু চার মাসের জন্য যোগ নিদ্রায় যান এবং তারপর তিনি শুধুমাত্র কার্তিক শুক্লা একাদশীতে জেগে ওঠেন এবং এই একাদশীতে তিনি তুলসীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এরপর কার্তিক পূর্ণিমায় সকল দেব-দেবীরা নারায়ণের ঘুম থেকে জেগে ওঠার আনন্দে লক্ষ্মী ও নারায়ণের মহা আরতি করে প্রচুর প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উদযাপন করেন।স্বর্গ প্রাপ্তির আনন্দে পালিত হয় দীপাবলি।
অন্য একটি বিশ্বাস অনুসারে, এটিও বলা হয় যে, বামনদেবের স্বর্গ প্রাপ্তির আনন্দে, সমস্ত দেবতা একসাথে কার্তিক মাসের পূর্ণিমা উদযাপন করেছিলেন এবং গঙ্গার তীরে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন, তখন থেকেই দেব দীপাবলি উদযাপনের প্রথা। শুরু হল দীপাবলি। কথিত আছে এই দিনে সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণু মৎস্য অবতার ধারণ করেছিলেন। আর এই দিনে দেবী তুলসী মাঁ র আবির্ভাব হয়। এছাড়াও একটি বিশ্বাস আছে যে কার্তিক পূর্ণিমায় কৃষ্ণ আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন।
কথিত আছে এই দিনে কুলদেবতা ও কুলদেবীকে স্মরণ করে তুলসী তলায় অথবা শিব মন্দিরে অথবা অশ্বত্থ গাছের নীচে কিংবা কুবের দেবতার নাম করে, আকাশ, ব্রহ্মান্ড-মন্ডলের সকল দেব দেবীর উদ্দেশ্যে বা আপনার গুরু দেবকে স্মরণ করে প্রদীপ জ্বালালে মনের অন্ধকার দূর হয় ও ঈশ্বরের কৃপা লাভ হয়।
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

Thursday, 13 October 2022

সনাতন ধর্মে যেকোন পূজার আগে গণেশের পূজার বিধি, কিন্তু কেন?

 

নাতন ধর্মে যেকোন পূজার আগে গণেশের পূজার বিধি, কিন্তু ‘গুরুপূজা’ গণেশ পূজারও আগে করার বিধান, অর্থাৎ গুরুপূজা অধ্যাত্মসাধনার প্রাথমিক কৃত্য। একথা হিন্দুর প্রাচীনতম শাস্ত্র বেদে বলা হয়েছে। হিন্দু ঐতিহ্যে গুরুর স্থান এমনই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, গুরু ভিন্ন কোন বিদ্যা কেউ আয়ত্ত করতে পারে না। সে-বিদ্যা ব্রহ্মবিদ্যাই হোক অথবা লোকবিদ্যাই হোক। পরাবিদ্যাই হোক অথবা অপরাবিদ্যাই হোক। বলা হয় “গুরু ছাড়া জ্ঞান লাভ অসম্ভব”সূর্যকে প্রকাশ করিতে মশালের প্রয়োজন হয় না। সূর্যকে দেখিবার জন্য আর বাতি জ্বালিতে হয় না। সূর্য উঠিলে আমরা স্বভাবতই জানিতে পারি যে সূর্য উঠিয়াছে; এইরূপ আমাদিগকে সাহায্য করিবার জন্য লোকগুরুর আবির্ভাব হইলে আত্মা স্বভাবতই জানিতে পারে যে, তাঁহার উপর সত্যের সূর্যালোক-সম্পাত আরম্ভ হইয়াছে। সত্য স্বতঃপ্রমাণ, উহা প্রমাণ করিতে অপর কোন সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয় নাই—উহা স্বপ্রকাশ; সত্য আমাদের অন্তস্তলে প্রবেশ করে, উহার সমক্ষে সমগ্র জগৎ দাঁড়াইয়া বলে—‘ইহাই সত্য।’ যে-সকল আচার্যের হৃদয়ে জ্ঞান ও সত্য সূর্যালোকের ন্যায় প্রতিভাত, তাঁহারা জগতের মধ্যে সর্বোচ্চ মহাপুরুষ, আর জগতের অধিকাংশ লোকই তাঁহাদিগকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করে। কিন্তু আমরা অপেক্ষাকৃত অল্পজ্ঞানীর নিকটও আধ্যাত্মিক সাহায্য লাভ করিতে পারি। তবে আমাদের এরূপ অন্তর্দৃষ্টি নাই যে, আমরা আমাদের গুরু বা আচার্যের সম্বন্ধে যথার্থ বিচার করিতে পারি; এই কারণে গুরুশিষ্য উভয়ের সম্বন্ধেই কতকগুলি পরীক্ষা আবশ্যক।শিষ্যের এই গুণগুলি আবশ্যক—পবিত্রতা, প্রকৃত জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যবসায়। অশুদ্ধাত্মা পুরুষ কখনও ধার্মিক হইতে পারে না। কায়মনোবাক্যে পবিত্র না হইলে কেহ কখনও ধার্মিক হইতে পারে না। আর জ্ঞানতৃষ্ণা সম্বন্ধে বলা যাইতে পারে যে, আমরা যাহা ছাই, তাহাই পাই—ইহা একটি সনাতন নিয়ম। যে বস্তু আমরা অন্তরের সহিত চাই, তাহা ছাড়া আমরা অন্য বস্তু লাভ করিতে পারি না। ধর্মের জন্য প্রকৃত ব্যাকুলতা বড় কঠিন জিনিষ; আমরা সচরাচর যত সহজ মনে করি, উহা তত সহজ নয়। শুধু ধর্মকথা শুনিলে আর ধর্মপুস্তক পড়িলেই যথেষ্টভাবে প্রমাণিত হয় না যে, হৃদয়ে ধর্মপিপাসা প্রবল হইয়াছে। যতদিন না প্রাণে ব্যাকুলতা জাগরিত হয় এবং যতদিন না আমরা প্রবৃত্তির উপর জয়লাভ করিতে পারি, ততদিন সদাসর্বদা অভ্যাস ও আমাদের পাশব প্রকৃতির সহিত নিরন্তর সংগ্রাম আবশ্যক। উহা দু-এক দিনের কর্ম নয়, কয়েক বৎসর বা দু-এক জন্মেরও কর্ম নয়; শত শত জন্ম ধরিয়া এই সংগ্রাম চলিতে পারে। কাহারও পক্ষে অল্পকালের মধ্যেই সিদ্ধিলাভ ঘটিতে পারে, কিন্তু যদি অনন্তকাল অপেক্ষা করিতে হয়, ধৈর্যের সহিত তাহার জন্যও প্রস্তুত থাকা চাই। যে শিষ্য এইরূপ অধ্যবসায়-সহকারে সাধনে প্রবৃত্ত হয়, তাহার সিদ্ধি অবশ্যম্ভাবী।
গুরু সম্বন্ধে এইটুকু দেখিতে হইবে, তিনি যেন শাস্ত্রের মর্মজ্ঞ হন। জগতের সকলেই বেদ বাইবেল বা কোরান পাঠ করিতেছে, কিন্তু শাস্ত্রসমূহ শুধু শব্দ এবং ব্যাকরণ—ধর্মের কয়েকখানা শুষ্ক অস্থিমাত্র। যে গুরু শব্দ লইয়া বেশী নাড়াচাড়া করেন ও মনকে কেবল শব্দের ব্যাখ্যা দ্বারা চালিত হইতে দেন, তিনি ভাব হারাইয়া ফেলেন। শাস্ত্রের মর্ম যিনি জানেন, তিনিই যথার্থ ধর্মাচার্য। শাস্ত্রের শব্দজাল যেন মহারণ্য, মানুষ নিজেকে উহার ভিতর হারাইয়া ফেলে, পথ খুঁজিয়া পায় না। ‘শব্দজাল মহারণ্যসদৃশ, চিত্তের ভ্রমণের কারণ।’২৩ ‘শব্দযোজনা, সুন্দর ভাষায় বক্তৃতা ও শাস্ত্রমর্ম ব্যাখ্যা করিবার বিভিন্ন উপায়—পণ্ডিতদিগের বিচার ও আমোদের বিষয়মাত্র, উহা দ্বারা সিদ্ধি বা মুক্তিলাভের সহায়তা হয় না।’২৪ যাহারা ধর্মব্যাখ্যার সময় এইরূপ প্রণালী অবলম্বন করে, তাহারা কেবল নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখাইতে ইচ্ছুক, তাহাদের ইচ্ছা—লোকে তাহাদিগকে মহাপণ্ডিত বলিয়া সম্মান করুক। জগতের প্রধান ধর্মাচার্যগণ কেহই এইভাবে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করিতে অগ্রসর হন নাই। তাঁহারা শাস্ত্রের শ্লোকের অর্থ যথেচ্ছ ব্যাখ্যা করিতে কখনও চেষ্টা করেন নাই, শব্দার্থ ও ধাত্বর্থ লইয়া ক্রমাগত মারপ্যাঁচ করেন নাই। তাঁহারা শুধু জগৎকে শাস্ত্রের মহান্ ভাব শিক্ষা দিয়াছেন। আর যাহাদের শিখাইবার কিছুই নাই, তাহারা হয়তো শাস্ত্র হইতে একটি শব্দ লইয়া তাহারই উপর এক তিনখণ্ডে এক পুস্তক রচনা করে। সেই শব্দের আদি কি, কে ঐ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করিয়াছিল, সে কি খাইত, কতক্ষণ ঘুমাইত, এইরূপ বিষয় লইয়াই কেহ হয়তো আলোচনা করিয়া গেলেন।
ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গল্প বলিতেনঃ এক আম-বাগানে কয়েকজন লোক বেড়াইতে গিয়াছিল; বাগানে ঢুকিয়া তাহারা গনিতে আরম্ভ করিল, কটা আম গাছ, কোন্ গাছে কত আম, এক-একটা ডালে কত পাতা, আমের বর্ণ, আকার, প্রকার ইত্যাদি নানাবিধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিচার করিতে লাগিল। আর একজন ছিল বিচক্ষণ, সে এসব গ্রাহ্য না করিয়া আম পাড়িতে লাগিল ও খাইতে লাগিল। বলো দেখি, কে বেশী বুদ্ধিমান্? আম খাও, পেট ভরিবে, কেবল পাতা গনিয়া—হিসাব করিয়া লাভ কি? এই পাতা-ডালপালা গোনা ও অপরকে উহার সংখ্যা জানাইবার চেষ্টা একেবারে ছাড়িয়া দাও। অবশ্য এরূপ কার্যের উপযোগিতা আছে, কিন্তু ধর্মরাজ্যে নয়। যাহারা এরূপ পাতা গনিয়া বেড়ায়, তাহাদের ভিতর হইতে কখনও একটিও ধর্মবীর বাহির করিতে পারিবে না। ধর্ম—যাহা মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য, মানুষের শ্রেষ্ঠ গৌরবের জিনিষ, তাহাতে পাতা-গোনারূপ অত পরিশ্রমের প্রয়োজন নাই। যদি তুমি ভক্ত হইতে চাও, তাহা হইলে কৃষ্ণ মথুরায় কি ব্রজে জন্মিয়াছিলেন, তিনি কি করিয়াছিলেন বা ঠিক কোন্‌ দিনে গীতা বলিয়াছিলেন, তাহা জানিবার কিছু আবশ্যক নাই। গীতায় কর্তব্য ও প্রেম সম্বন্ধে যে সুন্দর শিক্ষা আছে, আগ্রহের সহিত তাহা অনুসরণ করাই তোমার কাজ। উহার সম্বন্ধে বা উহার প্রণেতার সম্বন্ধে অন্যান্য বিশেষ বিবরণ জানা কেবল পণ্ডিতদের আমোদের জন্য। তাহারা যাহা চায় তাহা লইয়াই থাকুক। তাহাদের পণ্ডিতী তর্কবিচারে ‘শান্তিঃ শান্তিঃ’ বলিয়া এস আমরা আম খাইতে থাকি।
দ্বিতীয়তঃ গুরুর নিষ্পাপ হওয়া আবশ্যক। অনেক সময়ে লোকে বলিয়া থাকে, ‘গুরুর চরিত্র, গুরু কি করেন না করেন, দেখিবার প্রয়োজন কি? তিনি যা বলেন তাহাই বিচার করিতে হইবে। সেইটি লইয়াই কাজ করা প্রয়োজন।’ এ কথা ঠিক নয়। গতি-বিজ্ঞান, রসায়ন বা অন্য কোন জড়-বিজ্ঞানের শিক্ষক যাহাই হউন না কেন, কিছু আসে যায় না। কারণ উহাতে কেবল বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু অধ্যাত্মবিজ্ঞানের আচার্য অশুদ্ধচিত্ত হইলে তাঁহাতে আদৌ ধর্মালোক থাকিতে পারে না। অশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি কী ধর্ম শিখাইবে? নিজে আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করিবার বা অপরে শক্তি সঞ্চার করিবার একমাত্র উপায়—হৃদয় ও মনের পবিত্রতা। যতদিন না চিত্তশুদ্ধি হয়, ততদিন ভগবদ্দর্শন বা সেই অতীন্দ্রিয় সত্তার আভাসজ্ঞানও অসম্ভব। সুতরাং ধর্মাচার্যের সম্বন্ধে প্রথমেই দেখা আবশ্যক তিনি কি চরিত্রের লোক; তারপর তিনি কি বলেন তাহাও দেখিতে হইবে। তাঁহার সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক, তবেই তাঁহার কথার প্রকৃত একটা গুরুত্ব থাকে; কারণ তাহা হইলেই তিনি প্রকৃত শক্তি-সঞ্চারকের যোগ্য হইতে পারেন। নিজের মধ্যেই যদি সেই শক্তি না থাকে, তবে তিনি সঞ্চার করিবেন কী? গুরুর মন এরূপ প্রবল আধ্যাত্মিকস্পন্দন-বিশিষ্ট হওয়া চাই যে, তাহা যেন সমবেদনাবশে শিষ্যে সঞ্চারিত হইয়া যায়। গুরুর বাস্তবিক কার্যই এই—কিছু সঞ্চার করা, কেবল শিষ্যের বুদ্ধিশক্তি বা অন্য কোন শক্তি উত্তেজিত করিয়া দেওয়া নয়। বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, গুরু হইতে শিষ্যে যথার্থই একটি শক্তি আসিতেছে। সুতরাং গুরুর শুদ্ধচিত্ত হওয়া আবশ্যক।

করবা চৌথ-সনাতন ধর্মেরই এক অন্যতম উৎসব

 রবা চৌথ

এই উৎসবটি মুলতঃ সনাতন ধর্মের এক অন্যতম উৎসব যা মহিলারা তাঁদের স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনায় করে থাকেন। সৌর কার্তিক মাসের পূর্ণিমার পর কৃষ্ণা চতুর্থীতে পালিত হয় এই উৎসব। এই উৎসব বিশেষ ভাবে উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত সহ দিল্লী,রাজস্থান,পাঞ্জাব, হরিয়ানা বিহার, মধ্যপ্রদেশে ব্যাপক ভাবে পালিত হয়। এইদিনে মহিলারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাসে থেকে সন্ধ্যায় চাঁদ দর্শন করে উপবাস ভঙ্গ করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা সুর্যোদয়ের আগেই কিছু খাবার খেয়ে নেন যা সাধারণতঃ তাঁদের শাশুরিরা রান্না করে থাকেন, আর সেই বিশেষ খাবারকে ‘সার্গি’ বলা হয়। এতে রান্না করা খাবারের সাথে শুকনো ফল ও মিষ্টি ও থাকে।
 করবা চৌথের  সন্ধ্যায় শুরু হয় আসল উৎসব। গয়না আর নতুন পোশাকে সেজে, মেহেন্দিতে হাত রাঙিয়ে, এক জায়গায় জড়ো হন সবাই, যাঁরা ব্রত রেখেছেন। ‘করবা চৌথ’-এর পোশাক সাধারণত লাল, হলুদ বা সোনালি রঙের হয়। গান গাওয়া হয় একসঙ্গে। কোনও প্রবীণা বা কোনও পুরোহিত ব্রতকথা পাঠ করেন। আকাশে চতুর্থীর চাঁদ দেখা গেলে তা চালুনির মধ্যে দিয়ে দেখতে হয়। সঙ্গে থাকে প্রদীপ। চন্দ্রদেবতার কাছে স্বামীর মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন স্ত্রী। তারপর সেই প্রদীপের আলোয় দেখতে হয় স্বামীর মুখ। বরণডালা থেকে জলের পাত্র নিয়ে স্ত্রীর মুখে ধরেন স্বামী। সেই জল পান করেই ভঙ্গ হয় উপবাস।

এই ব্রত ছিল মূলত সৈন্যদের স্ত্রীদের জন্য। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সমাজের অন্য স্তরে। এখন তো সার্বিকভাবেই বিবাহিত মহিলারা এই ব্রত পালন করেন স্বামীর মঙ্গল কামনায়। সন্তান এবং স্ত্রীকে রেখে স্বামী যেতেন দূর দেশে, যুদ্ধক্ষেত্রে। পেশায় সৈন্য স্বামীর জন্য উদ্বেগের প্রহর গুনতেন স্ত্রী। তাঁর মঙ্গল কামনায় বিশেষ উপবাস ব্রত করতেন কার্তিক মাসের প্রথম পূর্ণিমার পরে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথিতে।
এক মতবাদ অনুযায়ী ভারতীয় কৃষি সভ্যতার সঙ্গে এই ব্রত জড়িয়ে আছে। এই সময়েই রবি শস্যের চাষ শুরু হয়। বপন করা হয় গমের দানা। আর যে বড় পাত্রে গমের দানা রাখা হয়, তাকেও ‘করবা’ বলা হয়। আবার অনেকের মতে যেহেতু ‘করবা’ শব্দের অর্থ কড়াই এবং ‘চৌথ’ মানে চতুর্থী তিথি। তাই এই দুয়ে মিলে ব্রতের নামকরণ। এই ব্রতে কড়াইয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা ব্রত রাখেন, তাঁরা নতুন কড়াই কেনেন। আর সেখানে রাখেন নতুন কাপড়, কাচের চুড়ি এবং বাড়িতে তৈরি মুখরোচক খাবার ও মিষ্টি। এইসময়ে একে অন্যের সঙ্গে সেই কড়াই আদানপ্রদানও করে থাকেন।
‘করবা চৌথ’ ব্রতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী । কথিত আছে যে রাণী বীরবতী তাঁর পিতৃগৃহে এই ব্রত পালন করছিলেন। কিন্তু উপবাসরত বোনের কষ্ট হচ্ছে ভেবে তাঁর সাত ভাই অশ্বত্থ গাছে আয়না রেখে দিলেন। যাতে মনে হয়, আকাশে চাঁদ উঠেছে। আয়নাকে চাঁদ ভেবে ভুল করে উপবাস ভঙ্গ করেন বীরবতী। তার পরেই স্বামীর মৃত্যুর খবর পান। শোকে মুহ্যমান হলেও বীরবতী আবার ‘করবা চৌথ’ পালন করে তাঁর স্বামীর প্রাণভিক্ষা করেন। প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে যমরাজ ফিরিয়ে দেন তাঁর স্বামীর প্রাণ।
আবার অনেক লোককথা অনুযায়ী, ‘করবা’ নামের এক পতিব্রতা নারী ছিলেন। তিনি যমরাজের মুখোমুখি হয়ে কুমিরের গ্রাস থেকে উদ্ধার করেছিলেন স্বামীকে। তাঁর নাম অনুসারে এই ব্রতের নামকরণ হয় করবা চৌথ।

Monday, 2 May 2022

প্রসঙ্গঃ- অক্ষয় তৃতীয়া

 

আজ অক্ষয় তৃতীয়া অনেক গুরুত্ব পূর্ণ দিন বলে বিবেচিত হয় আজকের দিনটিকে।
অক্ষয় তিথির মাহাত্ম্য::::---
অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথি।এ অক্ষয় তৃতীয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তিথি। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না।
বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যদি ভালো কাজ করা হয় তার জন্যে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য আর যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে লাভ হয় অক্ষয় পাপ।আর এদিন পূজা,জপ,ধ্যান,দান, অপরের মনে আনন্দ দেয়ার মত কাজ করা উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় সতর্কভাবে।এদিনটা ভালোভাবে কাটানোর অর্থ সাধনজগতের অনেকটা পথ একদিনে চলে ফেলা।এবারের অক্ষয়তৃতীয়া সবার ভালো কাটুক-এই কামনায় করি।
কি কি ঘঠেছিল আজকের এই তিথিতে?
১) এদিনই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম আবির্ভুত হন পৃথিবীতে।
২) এদিনই রাজা ভগীরথ গঙ্গা দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন।
৩) এদিনই গণপতি গনেশ বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন।
৪) এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে।
৫) এদিনই সত্যযুগের সূচনা হয়।
৬) এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন।এদিনই কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এদিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
৭) এদিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রী কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে সামান্য চালভাজা নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সকল দুঃখ মোচন করেন।
৮) এদিনই দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং সখী কৃষ্ণাকে রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণ।শরনাগতের পরিত্রাতা রূপে এদিন শ্রী কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
৯) এদিনে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়।
১০) কেদার-বদরী-গঙ্গোত্রী-যমুনত্রীর যে মন্দির শীতকাল ছয়মাস বন্ধ থাকে এইদিনেই তার দ্বার উদঘাটন হয়।দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল।
১১) এদিনই সত্যযুগের শেষ হয়ে প্রতি কল্পে ত্রেতা যুগ শুরু হয়।
আজ দিনটি আরেকটি ব্যাপারেও অনেক গুরুত্ব পুর্ণ
আজ থেকে শ্রীকৃষ্ণের চন্দন যাত্রা উৎসবের ও শুভারম্ভ হয় আর চলে আগামী ২১ দিন পযর্ন্ত।
চন্দন যাত্রা কি?
উৎকলখণ্ডে বর্ণিত আছে,শ্রীজগন্নাথদেব মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে বৈশাখী শুক্লা অক্ষয় তৃতীয়াতে সুগন্ধি চন্দন দ্বারা জগন্নাথের অঙ্গে লেপন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।সেদিন থেকে চন্দন যাত্রা উৎসব শুরু হলো।শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে দেখা যায়,বৃন্দাবনে পরম বৈষ্ণব শ্রীমাধবেন্দ্র পুরীকে স্বপ্নে তাঁর আরাধ্য শ্রীগোপাল বলছেন,"আমার শরীরের তাপ জুড়াচ্ছে না। মলয় প্রদেশ থেকে চন্দন নিয়ে এসো এবং তা ঘষে আমার অঙ্গে লেপন কর,তা হলে তাপ জুড়াবে।"তার পর পূর্বভারতে বৃদ্ধ মাধবেন্দ্র পুরী নীলাচলে জগন্নাথ পুরীতে এসে সেবকদের কাছ এক মণ মলয়জ চন্দন ও কর্পূর নিয়ে বৃন্দাবনে ফিরছিলেন।পথে রেমুণাতে শ্রীগোপীনাথ মন্দিরে আসেন।সেই রাত্রে সেখানে শয়ন কালে স্বপ্ন দেখেন,গোপাল এসে বলছেন,"হে মাধবেন্দ্র পুরী,আমি ইতিমধ্যেই সমস্ত চন্দন ও কর্পূর গ্রহণ করেছি।এখন কর্পূর সহ ঐ চন্দন ঘষে ঘষে শ্রীগোপীনাথের অঙ্গে লেপন কর।গোপীনাথ ও আমি অভিন্ন।গোপীনাথের অঙ্গে চন্দন লাগালেই আমার অঙ্গ শীতল হবে।"গ্রীষ্ম ঋতুতে শ্রীহরির অঙ্গে কর্পূর চন্দন লেপন করলে ভগবান শ্রীহরি প্রীত হন। আজ থেকে ২১ দিন ভগবানের শরীরে চন্দন লেপন করতে পারেন জগতের মঙ্গল কামনা করে ।

Friday, 26 November 2021

প্রসঙ্গঃ- শনিদেব বা শনিশ্চর

প্রসঙ্গঃ-  শনিদেব বা শনিশ্চর
সঙ্কলক
শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

'শনি' নবগ্রহের একটি অন্যতম গ্রহ, শনি গ্রহকে গ্রহরাজ-ও বলা হয়ে থাকে। শনিদেব সনাতন ধর্ম মতে একজন দেবতা। তিনি উগ্র দেবতা বলে কুখ্যাত।শনিদেবের পরিচয় হল, তিনি হলেন সূর্যদেব ও তার পত্নী ছায়াদেবীর (সূর্যদেবের স্ত্রী ও দেব বিশ্বকর্মার কন্যা দেবী সঙ্ঘামিত্রার ছায়া থেকে সৃষ্ট দেবী ছায়া) পুত্র, এজন্য তাকে ছায়াপুত্র-ও বলা হয়। শনিদেব, মৃত্যু ও ন্যায় বিচারের দেবতা যমদেব বা ধর্মরাজ ও পবিত্র শ্রী যমুনা দেবীর ভ্রাতা।
বিভিন্ন হিন্দু পুরাণে শনির কাহিনি সম্পর্কে ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। মৎস্য পুরাণে বলা হচ্ছে, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার মেয়ে সঙ্ঘামিত্রা সঙ্গে বিয়ে হয় সূর্যদেবের। কিন্তু সূর্যের প্রচণ্ড তাপে প্রায় ঝলসে যান সঞ্জনা। তখন তাঁর নতুন নাম হয় সন্ধ্যা। নিজের এমন দূরবস্থায় স্বামীর প্রতি সমস্ত ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেন তিনি। সূর্যের থেকে দূরে পালাতে চান তিনি। কিন্তু কী ভাবে? তখন সন্ধ্যা নিজেরই একটি প্রতিকৃতি সৃষ্টি করেন। বলা যেতে পারে এটিই বিশ্বের প্রথম ক্লোন। তাঁর নাম দেন ছায়া। ছায়াকে স্বামীর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে সন্ধ্যা পিতার ঘরে ফিরে যান। এ ভাবে যে তাঁর স্ত্রী বদল হয়ে গেল তা খেয়ালই করেন না সূর্যদেব।
পরবর্তীকালে সূর্য ও ছায়ার সন্তান হিসেবে জন্ম নেন শনি। মেয়ে তাঁর কাছে, এদিকে সূর্যের সন্তান-জন্মের খবর পেয়ে বিশ্বকর্মা ধন্দে পড়ে যান। সন্ধ্যার কাছে ছুটে গিয়ে সব জানতে চান। সব শুনে বিশ্বকর্মা সন্ধ্যাকে সেই মুহূর্তেই পতিগৃহে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। ক্ষুব্ধ সন্ধ্যা ফিরে গিয়ে ছায়াকে নিঃশেষ করে নিজে ফের সূর্যের স্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এ ঘটনাও সূর্যের নজর এড়িয়ে যায়।
এর পর শনির প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে শুরু করেন সন্ধ্যা। শনিকে সূর্যের থেকে দূরে সরাতে অনবরত স্বামীর কান ভাঙাতে থাকেন সন্ধ্যা। এভাবে মায়ের স্নেহ এবং বাবার ভালোবাসা না পেয়ে ক্রুদ্ধ, বিরক্ত, অলস হয়ে উঠতে থাকেন শনি। কোনও কিছুই তাঁর ভালো লাগে না।
পরবর্তীকালে সূর্যের ঔরসে সন্ধ্যার গর্ভে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখা হয় যম ও মেয়ের নাম যমুনা। ক্রমে ছেলে-মেয়েরা বড় হলে তাঁদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন সূর্য। যমকে দেওয়া হয় ধর্মরাজের দায়িত্ব। পৃথিবীর বুকে ধর্মরক্ষার দায়িত্ব তাঁর। যমুনা পবিত্র নদীর রূপ নিয়ে সব পাপ-তাপ ধুয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পান।
সন্ধ্যার ক্রমাগত কান ভাঙানোর ফলে বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শনিকে কোনও দায়িত্বই দেন না সূর্য। এ ভাবে বঞ্চিত, অসহায় শনি ভাই-বোনের থেকে দূরে সরে গিয়ে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। একদিন শোক ও রাগে পাগল হয়ে সন্ধ্যাকে লাথি মারেন তিনি। সেই রাগে শনিকে খোঁড়া হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন সন্ধ্যা। মা-কে লাথি মারার জন্য শনির ওপর সূর্য ক্রুদ্ধ হলেও বেশি অবাক হন সন্ধ্যার ভূমিকায়। একজন মা কী করে তাঁর সন্তানকে এমন অভিশাপ দিতে পারেন! সন্ধ্যার কাছে সব কথা জানতে চান তিনি। সূর্যের জেরায় ভেঙে পড়ে অবশেষে তাঁকে সব জানাতে বাধ্য হন সন্ধ্যা। শনির ওপর এতদিন এত অন্যায় হয়েছে বুঝতে পেরে নিজের ভুল স্বীকার করেন সূর্য। শনিকে সৌরমণ্ডলে স্থান দেন তিনি। কর্মফলের দেবতা হিসেবে শনিকে উন্নীত করা হয়। এ জন্যই কেউ কোনও অপকর্ম করলে শনির নজর এড়ায় না এবং শনির হাতে তার শাস্তি নিশ্চিত।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে একদিন শনি দেবের স্ত্রী দেবী ধামিনী সুন্দর বেশভূষা নিয়ে তার কাছে এসে কামতৃপ্তি প্রার্থনার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি সেদিকে খেয়ালই করেন না। যার ফলে অতৃপ্তকাম পত্নী শনিকে অভিশাপ দিলেন, ‘আমার দিকে একবারও তুমি ফিরেও চাইলে না। ঠিক আছে এরপর থেকে তুমি যার দিকে চাইবে, সে-ই ভস্ম হয়ে যাবে’। তবে অনেকের মত ঘটনাটি মঙ্গলদেবের চক্রান্তে হয়েছিল।
আরো একটি কাহিনী
শনি দেবের জন্ম নিয়ে পুরাণে অনেক কিছু বর্ণনা রয়েছে। শোনা যায়, সূর্যদেবের স্ত্রী সঙ্ঘামিত্রা দেবী, তাঁর স্বামীর প্রখরতা ও তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীর থেকে ছায়ার সৃষ্টি করেন। সেই ছায়া তিনি নিজের জায়গায় বসিয়ে রেখে তপস্যায় যান। সেই সময় ছায়ার সঙ্গে সূর্যদেবের মিলনের ফলে শনির জন্ম হয়।কিন্তু তাঁর গায়ের রং হয় কুচকুচে কালো, যা নিয়ে সূর্যদেব দেবী ছায়াকে তাঁর পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। মায়ের এই অপমান সহ্য করতে পারতেন না শনি দেব। একদিন বদলা নিতে অগ্নিদৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকান তিনি। যার ফলস্বরূপ সূর্য পুড়ে কালো হয়ে যান।সেই সময় শিব এসে রক্ষা করেন সূর্যকে। শিবই সূর্যকে সমস্ত সত্যি জানান এবং কোনও অন্যায় দেখলে তার বিচার করার ক্ষমতা দিয়ে যান শনিকে। সেই থেকেই বিচারের দেবতা হিসাবে পরিচিত শনি দেব।
শনিদেবকে কোনও অপশক্তি মনে করলে ভুল করা হবে। তিনি ইচ্ছা করে কোনসময় কারোকে বিপদে ফেলেন না। গ্রহ হিসেবে শনি নিয়মানুবর্তিতা, পরিশ্রম, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করেন। এই গুণগুলি থেকে বিচ্যুত হলে তিনি কুপিত হন। মানুষের যাবতীয় কর্ম— ভাল-মন্দ কিছুকেই শনিদেব লক্ষ করেন। দুষ্কর্মের জন্য তিনি রুষ্ট হন। কতগুলি সদগুণ শনি যেমন নিয়ন্ত্রণ করেন,তেমনই দুর্ঘটনা, লোভ, নেশা বা আসক্তি, অপরাধ প্রবণতাকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। শনিদেব কিন্তু পরম শিবভক্ত। কারো প্রতি শনি কুপিত হলে তিনি আগে থেকেই তার আভাস পেয়ে যাবেন অন্তত আমাদের জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার উল্লেখ আছে। আমরা প্রায়ই শুনি শনির দশা চলেছে। একথা অপ্রিয় হলেও সত্যি আমাদের ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণে শনিদেব এক অতি পরিচিত দেবতা উনাকে নিয়ে হাজারো কাহিনীর পরিচয় আমরা পাই। তার মধ্যে একটি অতি জনপ্রিয় কাহিনী হল নল-দময়ন্তীর। শনির প্রকোপে রাজা নলের কী দশা হয়েছিল, তা আমরা সকলেই অবগত।
এবার আপনারা বলুন তো, আপনারা কি ভাবেন, সত্যিই কি শনি এক ভয়ানক দেবতা?

May be an image of sky
Like
Comment

Friday, 3 September 2021

প্রসঙ্গঃ- শ্রীমতি রাধারাণী

 শ্রীমতি রাধারাণী

সঙ্কলকঃ শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী


আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে এক প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খায়, শ্রী কৃষ্ণ নামের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত যে শ্রী রাধার নাম সে রাধা আসলে কে? ...সে প্রশ্নের উত্তর খুজতে খুজতে এক বিশাল সাগরে ডুব মারার অবস্থা হয়েছে, আমি নিজেও চেষ্টা করছি সেই প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানের । এই প্রচেষ্টায় যে টুকু প্রাপ্ত জ্ঞান তা আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরার যথাসাধ্য প্রয়াস করে যাবো... আগেই বলেছি এ এক বিশাল ব্যাপার  তাই  আমি শুরু করার আগে পরমেশ্বরের কাছে আশীর্বাদ কামনা করে নিচ্ছি এই যে তিনি যেন আমার সাথে এই কাজে সহায়তা করে থাকেন...।

ঋষি বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর রচিত 'কৃষ্ণচরিত্র' প্রবন্ধে যেভাবে রাধাকে বর্ণণা করেছেন তা কিছুটা এইরূপ...

"ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আর জয়দেবের কাব্য ভিন্ন কোন প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নেই। ভাগবতের এই রাসপঞ্চাধ্যায়ের মধ্যে 'রাধা' নাম কোথাও পাওয়া যায় না। বৈষ্ণবাচার্যদিগের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাঁহারা টীকা টিপ্পনীর ভিতর পুনঃপুনঃ রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়াছেন কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নাই। গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈর্ষার প্রমাণ স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে তাহারা পদচিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিলেন যে, কোন এক গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রম মাত্র। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকে লইয়া অন্তর্হিত হইলেন এমন কথা নাই এবং রাধার নামগন্ধও নাই।

রাসপঞ্চাধ্যায়ে কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নেই। ভাগবতে কেন, বিষ্ণুপুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নেই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা! রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণ নাম নেই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নেই বা মূর্তি নেই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন, তবে এ 'রাধা' আসিলেন কোথা হইতে?"

শুধু তিনিই নন, 'বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়' এর লেখক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক,ডঃ শশীভূষন দাশগুপ্ত, ডঃ নীহার রঞ্জন রায় প্রমুখ ব্যক্তিরাও শ্রীমতি রাধার চরিত্রকে ভ্রান্ত এবং মধ্যযুগ পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদী সম্প্রদায় কর্তৃক নতুন করে আবিষ্কৃত এক পৃথক সত্বা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বেদে রাধার বর্ণনা ????

আজকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার আগে আমি কিছু আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক কিন্তু 'স্পর্শকাতর' তাই আমি বলে রাখছি আমি কিন্তু কারো ভাব বা বিস্বাসে আঘাত দেওয়ার পক্ষপাতী নই। শ্রীভগবান গীতায় বলছেন- যে "যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম" যে আমাকে যে ভাবে ভজনা করে, আমিও তাকে সেইভাবে ভজনা করি। কথা হল ভক্তিতে ভাব থাকা চাই, ভালোবাসা দ্বারা ভক্তি চাই। আমার কাছে তেমন কোন তথ্য না থাকায় বহুলাংশে আমি ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন ভাষায় উপলব্ধ বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে আমার এই পরিবেশন অতএব অজ্ঞানবশতঃ ভুল ভ্রান্তির সম্ভাবনা প্রবল শুধুমাত্র নিজের কৌতূহল ও পাঠকদের অনুপ্রেরনা আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।  

আমি আজ আমাদের আদিগ্রন্থ 'বেদ' এ দেখবো কি আছে? কেননা কিছু ব্যাক্তিরা দাবী করছেন যে বেদে রাধার বর্ণনা আছে। সত্যি কি তাই???

ব্যাকরণের দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে পাই , যিনি আরাধনা করেন, তাকে এক কথায় তাকেই বলা হয় রাধা। বৈদিক শব্দ কোষেও রাধ্ শব্দের অর্থ আরাধনা করা এই অর্থে সকল ভক্ত যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভজনা বা আরাধনা করেন, তারাই রাধা তাই পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার আত্মসমর্পণই কৃষ্ণের প্রতি রাধার আত্মসমর্পনের রূপ পেয়েছে। আবার যেমন বিরহের প্রচণ্ড ব্যাকুলতা ছাড়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা সম্ভব নয়, তাই রাধা রূপী জীবাত্মাও, ভক্তের কাছে নারী রূপী রাধায় পরিণত হয়ে উঠেছে।

এবার দেখে নেবো কিছু সংখ্যক ব্যাক্তিরা যারা দাবী করে চলেছেন যে রাধার বর্ণনা বেদেও আছে, তাঁদের যুক্তি কতটুকু গ্রহন যোগ্য।

য়দিন্দ্র চিত্রম ইহ নাস্তি ত্বাদাতমন্দ্রিবঃ।

রাধস্তন্নো বিদপূস উভয়া হস্ত্য আভব”।।

এ মন্ত্রে রাধস্তন্নো যে শব্দটি রয়েছে তা কিন্তু সেই 'রাধা’ নয় এখানে রাধ শব্দের অর্থ হলো আরাধ্য শক্তি। এই মন্ত্রটির যথার্থ ভাবার্থ অনুধাবন করলে আমরা পাই..।।

হে (ইন্দ্র) ইন্দ্র পরমাত্মন! আপনি (য়ৎ) এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে যাহা কিছু (চিত্র) নানা প্রকার চিত্র বিচিত্র রূপে ( আদ্রিবঃ) বিশাল সমুদ্র বা জলাদির ধারায় পর্বত সদৃশ্য বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্বামী কর্তা বিধাতা হন। আপনি কৃপয়া (মে) আমাদেরকে (ত্বাদাতম) যাহা কিছু প্রদান করেন তাহারা বিস্তৃতভাবে (তৎ) এ (রাধঃ) আরাধ্য শক্তি (বিদৎ বসো) বিদ্বান যোগী তপস্বী সাধক জনদের মধ্যে সাধনার দ্বারা লব্ধ ওই শক্তি (নঃ) আমাদের জন্য ( উভয়া হস্ত ভব) উভয় হাতে উন্মুক্তভাবে প্রদান করুন।

বেদের অপর একটি শ্লোকে আছে যে

ইদং হ্যন্বোজসা সুতং রাধানাং পতে।

পিবা ত্বাস্য গিবর্ণঃ।।

এখানে " রাধানাং পতে" শব্দটির অর্থ শ্রীকৃষ্ণ নয়। এখানে এই শব্দ দুটির অর্থ হল সৃষ্টির জ্ঞান-ধন-প্রজা ঐশ্বর্য ইন্দ্রিয় ইত্যাদির মালিক।

মন্ত্রটির ভাবার্থটি এইপ্রকার

হে মনুষ্য! ( রাধানাম পতে) এই অনন্ত ব্রহ্মান্ডের মধ্য সৃষ্টির জ্ঞান -ধন- প্রজা ঐশ্বর্য ইন্দ্রিয় আদির মালিক যিনি ( ইদং) বিশ্বজগৎকে নিজের শক্তি বল পরাক্রমের দ্বারা (সুতং) নিখুঁত ভাবে সৃজন করে, তাহার সমস্ত জ্ঞান প্রাপ্তির উপাই (গিবর্ণ) দেব বাণী আদির প্রদান করে (তু) তোমরা সকলে তাহাকে ভালোভাবে গ্রহন করে (আপিব) ঈশ্বরের জ্ঞান কে পান করো।

আরেকটি শ্লোকে পাই

অভীষুণঃ সখীনামবিতা জরিতৃণাম।

শতং ভবাস্যুতয়ে।।

এখানে কিন্তু সখীনাম শব্দের অর্থ রাধা নয়।যা অনেকে দাবী করে থাকেন ।এর আসল অর্থ হচ্ছে সখার চেয়েও মহান সখা অর্থাৎ পরমেশ্বর।

মন্ত্রটির অর্থ হলো

হে পরমেশ্বর! (নঃ) আপনি আমাদের একমাত্র (অভি) চারিদিক থেকেই (সু আবিতা) সুরক্ষা করে থাকেন। সেই জন্য সকলে আপনারই (সখীনাম) সখার চেয়েও সখা যুক্ত মহান সখারূপে আপনি সর্বদাই (জরিতৃণাম) স্তুতি প্রার্থনা উপাসনা কারীদের প্রতি আপনি (শতম) শত সহস্র হাজার হাজার উপায়ে আমাদেরকে (উতয়ে) সুরক্ষা করে নিরন্তরই (ভবাসি) নিজের স্বরূপেই বিদ্বমান থাকেন।

আরেক জায়গায় আছে

ইন্দ্রস্য সোমরাধসে পুনানো হাদিচোদয়।

দেবনং য়োণিমাসদম।।

এই মন্ত্রে "রাধসে" শব্দটি আরাধনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কোন

বিশিষ্ট ব্যক্তিবাচক নাম হিসেবে ব্যবহার হয়নি।

মন্ত্রটির অর্থ খুজলেই তা পাওয়া যায়।

হে মনুষ্য (রাধসে) পরমেশ্বরের সাধন ভজন আরাধনার জন্য প্রথমে হৃদয় সহকারে (দেবানং) পঞ্চ ভৌতিক শরীরের সমস্ত দিব্য গুন কর্ম স্বভাবকে নিয়ে জড় চেতন তত্ত্বের জ্ঞান লাভ করে (অসদম) মূল তত্ত্ব জ্ঞানের শরীর বিজ্ঞান -আত্ম বিজ্ঞান এবং পরমাত্মা বিজ্ঞানের (য়োনীং) মূল কারনকে (চোদয়) কেবলমাত্র ইশ্বরের দিকেই নিরন্তর প্রেরন করতে থাকে। কেননা অনন্ত সৃষ্টির মূল কারন বা বীজ পরমাত্মাই।

অপর একটি শ্লোকে আছে...

দুক্ষ্যং সুদানং তবিষীভিরাবৃতং গিরিং ন পুরুভোজসম।

ক্ষমন্তং বাজং শতিনং সহস্রিনং মক্ষু গোমন্তমীমহে।।

যার আসল অর্থ এই রূপ

হে সাধক মনুষ্য! (দুক্ষং) দিব্যগুন কর্ম স্বভাব যুক্ত (সুদানং) উত্তম দাতা (তবিষীভি) নানা প্রকার বল শক্তি দ্বারা (আবৃতঃ) চতুর্দিকে আবৃত অবস্থায় (শতিনং) শত ( সহস্রিনং) হাজার হাজার (গোমন্তা) গো বংশে ইন্দ্রিয় বৃত্তি সমূহ তথা বাণীর ধারা দিয়ে (বাজং) বল বীর্য পরাক্রমে সর্বদাই আমরা (ঈমহে) প্রাপ্তির জন্য শুভ কামনা করে থাকি।

এখানে "গোমন্ত" শব্দের সাথে রাধা নামের মিল খুঁজে পেয়েছেন কিছু সংখ্যক ব্যাক্তি, কিন্তু আসলে শব্দের অর্থ হলো গো বংশে ইন্দ্রিয় বৃত্তিসমূহ।

 আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে লেখা মহাভারত সেখানেও রাধার কোন উল্লেখ নেই অতএব গীতাতেও রাধার কথা থাকা সম্ভব নয়। এমন কি বিষ্ণুপুরানে ও রাধার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে রাধার উল্লেখ আছে, এছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলী, যা রাধার, কৃষ্ণের প্রতি প্রেম বিরহ নিয়ে লেখা একাধিক কবির পদ্য এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, এইসবে রাধার উল্লেখ আছে। এইসকল দিক দিয়ে চিন্তা করলে রাধার বিষয় নিয়ে একটি সংশয় থেকেই যায়। আপনারা লক্ষ্য করলে দেখে থাকবেন যে প্রাচীন হাজার বছরের পুরানো যতগুলো মন্দির আছে সেই সব কোন মন্দিরেই কৃষ্ণের রাধাকে দেখা যায় না। কারণ রাধার জন্মই হয়েছে মধ্যযুগের কবিদের কল্পনায়! রাধাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহিত্যরস সৃষ্টির খাতিরে। সেই জন্যে আমরা রাধাকে ব্যাপকভাবে দেখতে পাই সাহিত্য জগতে। বৈষ্ণব কাব্যে কবি জয়দেব, কবি চণ্ডীদাস, কবি বিদ্যাপতি, কবি জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, কবি বলরাম দাস প্রভৃতি কবিদের রচনার ছত্রে ছত্রে রাধা আছেন। নানা ভাব মাধুর্যের লীলা রসে সদাই রাধা বিচরণশীল।

রাধা আসলেই কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দার্শনিকরা দার্শনিকতত্ত্ব রূপে যা কিনা মাত্র কয়েকশো বছরের প্রাচীন শ্রীকৃষ্ণের লীলা শক্তির যে প্রধান তিন ভাগের স্বরূপ শক্তি, জীবশক্তি ও মায়া শক্তির বর্ণণা করেছেন সেই তিনটি মূখ্য উপভাগ রয়েছে (অর্থাৎ সৎ, চিৎ ও আনন্দ) সেই উপভাগের মধ্যে আনন্দ তত্ত্বটি বা হ্লাদিনী তত্ত্বের মানবী রূপ হিসেবে কল্পনা করেছেন রাধাকে। অর্থাৎ রাধা হলেন সম্পূর্ণত গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এবং গৌড়ীয় দার্শনিকদের আনন্দ বা হ্লাদিনী নামক তত্ত্বের কাল্পনিক মানবিক চরিত্র মাত্র! রাধার কোন ঐতিহাসিকতা বা বাস্তব অস্তিত্ব কোন কালেও ছিল না।

পরিশেষে এতটুকুই বলবো যে

শ্রী কথার অর্থ শক্তি অর্থাৎ রাধা। কৃষ্ণ যদি শব্দ হন তাহলে রাধা তার অর্থ, কৃষ্ণ যদি বাঁশী হন তাহলে রাধা তার সুর, কৃষ্ণ সমুদ্র হলে রাধা তার তরঙ্গ, কৃষ্ণ যদি ফুল হন রাধা তার সুগন্ধি। আসলে রাধা হলেন শ্রী কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। তাঁরা একে অন্যের থেকে পৃথক নন। ভক্তের জন্যে তাঁরা পৃথক রূপ ধারন করেন ও পৃথক পৃথক ভাবে লীলা করে থাকেন। রাধা এক আধ্যাত্মিক রূপ যেখানে দ্বৈত ও অদ্বৈতের মিলন। রাধা এক সম্পূর্ণ কালের উদ্গম যা শ্রীকৃষ্ণ সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়।শ্রীকৃষ্ণের জীবনে রাধা প্রেমঘন মূর্তিরূপে বিরাজিত। কৃষ্ণ প্রেমের পরিমান কেউ মাপতে পারেনি। সেই প্রেমের আধার শিলা রাধাই স্থাপন করেছিলেন। সমগ্র ব্রহ্মান্ডের আত্মা হলেন গিয়ে রাধা আর শ্রী কৃষ্ণের আত্মা হলেন গিয়ে রাধা। আত্মাকে কি কেউ কখনো দেখতে পেরেছে? না তা সম্ভব নয়। সেই ভাবে রাধা ও চিরকাল ভক্ত-মানসে রহস্য হয়ে থাকবেন।

সমাপ্ত।

হরি ওম তৎ সৎ। শ্রী রামকৃষ্ণায় অর্পনোমস্তু।।


কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...