কথামৃতের চতুর্থ পরিচ্ছেদে আমরা পাই ঠাকুর
শ্রীরামকৃষ্ণ কিভাবে মাষ্টারমশাইর অহংকার চূর্ণ করেছিলেন।প্রকৃত পক্ষে এখানে
মাষ্টারমশাই উপলক্ষ্য মাত্র মাষ্টারমশাইকে নিদর্শন রেখে ঠাকুর আমাদের
দর্পচূর্ণ...আমাদের ভূলধারণার অবশান...করতে চেয়েছেন। দুই তিনটা বই পরে আমাদের মনে
হয় আমরা জ্ঞানী হয়ে গেছি কিন্তু ঠাকুর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আসলে
জ্ঞানী বলতে কি বোঝায়। ওহো আমি তো ভূলেই গেছি সেই পরিচ্ছেদটা পড়া হয়েছে তো? পড়া না
হলে বা মনে না থাকলে আপনাদের সুবিধার্থে এখানে তুলে দিচ্ছি
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮২ মার্চ
অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া ৷
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ৷৷
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ৷৷
মাস্টারকে তিরস্কার
ও তাঁহার অহঙ্কার
চূর্ণকরণ
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) -- তোমার কি বিবাহ হয়েছে?
মাস্টার -- আজ্ঞে হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (শিহরিয়া) -- ওরে রামলাল১ যাঃ, বিয়ে করে ফেলেছে!
মাস্টার ঘোরতর অপরাধীর ন্যায় অবাক্ হইয়া অবনতমস্তকে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। ভাবিতে লাগিলেন, বিয়ে করা কি এত দোষ!
ঠাকুর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার কি ছেলে হয়েছে?
মাস্টারের বুক ঢিপঢিপ করিতেছে। ভয়ে ভয়ে বলিলেন, আজ্ঞে, ছেলে হয়েছে।
ঠাকুর আবার আক্ষেপ করিয়া বলিতেছেন, যাঃ, ছেলে হয়ে গেছে!
তিরস্কৃত হইয়া তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। তাঁহার অহঙ্কার চূর্ণ হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কৃপাদৃষ্টি করিয়া সস্নেহে বলিতে লাগিলেন,
“দেখ, তোমার লক্ষণ ভাল ছিল, আমি কপাল, চোখ - এ-সব দেখলে বুঝতে পারি।
আচ্ছা, তোমার পরিবার কেমন? বিদ্যাশক্তি না অবিদ্যাশক্তি?”
[জ্ঞান কাহাকে বলে? প্রতিমাপূজা ]
মাস্টার -- আজ্ঞা ভাল, কিন্তু অজ্ঞান।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত
হইয়া) -- আর তুমি জ্ঞানী?
তিনি জ্ঞান
কাহাকে বলে, অজ্ঞান কাহাকে
বলে, এখনও জানেন
না। এখনও পর্যন্ত জানিতেন
যে, লেখাপড়া শিখিলে
ও বই পড়িতে পারিলে জ্ঞান
হয়। এই ভ্রম
পরে দূর হইয়াছিল। তখন শুনিলেন
যে, ঈশ্বরকে জানার
নাম জ্ঞান, ঈশ্বরকে না
জানার নামই অজ্ঞান। ঠাকুর বলিলেন, “তুমি কি
জ্ঞানী!” মাস্টারের অহঙ্কারে আবার
বিশেষ আঘাত লাগিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ -- আচ্ছা, তোমার ‘সাকারে’ বিশ্বাস, না ‘নিরাকারে’?
মাস্টার (অবাক্
হইয়া স্বগত) -- সাকারে বিশ্বাস থাকলে
কি নিরাকারে বিশ্বাস
হয়? ঈশ্বর নিরাকার, এ-বিশ্বাস
থাকিলে ঈশ্বর সাকার এ-বিশ্বাস
কি হইতে পারে? বিরুদ্ধ অবস্থা
দুটাই কি সত্য হইতে পারে? সাদা জিনিস
-- দুধ, কি আবার
কালো হতে পারে?
মাস্টার -- আজ্ঞা, নিরাকার
-- আমার এইটি ভাল লাগে।
শ্রীরামকৃষ্ণ -- তা
বেশ। একটাতে বিশ্বাস থাকলেই
হল। নিরাকারে বিশ্বাস, তাতো ভালই। তবে এ-বুদ্ধি
করো না যে, এইটি কেবল
সত্য আর সব মিথ্যা। এইটি জেনো
যে, নিরাকারও সত্য
আবার সাকারও সত্য। তোমার যেটি
বিশ্বাস, সেইটিই ধরে থাকবে।
মাস্টার দুইই সত্য
এই কথা বারবার শুনিয়া
অবাক্ হইয়া রহিলেন। এ-কথা তো
তাঁহার পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে
নাই।
তাঁহার অহঙ্কার তৃতীয়বার চূর্ণ
হইতে লাগিল। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ
হয় নাই। তাই
আবার একটু তর্ক করিতে
অগ্রসর হইলেন।
মাস্টার -- আজ্ঞা, তিনি সাকার, এ-বিশ্বাস
যেন হল! কিন্তু মাটির প্রতিমা
তিনি তো নন --
শ্রীরামকৃষ্ণ -- মাটি
কেন গো! চিন্ময়ী প্রতিমা।
মাস্টার ‘চিন্ময়ী প্রতিমা’ বুঝিতে পারিলেন
না। বলিলেন, আচ্ছা, যারা মাটির প্রতিমা
পূজা করে, তাদের তো বুঝিয়ে
দেওয়া উচিত যে, মাটির প্রতিমা ঈশ্বর
নয়, আর প্রতিমার সম্মুখে ঈশ্বরকে
উদ্দেশ করে পূজা করা উচিত।
[লেকচার (Lecture) ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্ত
হইয়া) -- তোমাদের কলকাতার লোকের
ওই এক! কেবল লেকচার দেওয়া, আর বুঝিয়ে
দেওয়া! আপনাকে কে বোঝায়
তার ঠিক নাই।! তুমি বুঝাবার
কে? যাঁর জগৎ, তিনি বুঝাবেন। যিনি এই
জগৎ করেছেন, চন্দ্র, সূর্য, মানুষ, জীবজন্তু করেছেন; জীবজন্তুদের খাবার
উপায়, পালন করবার জন্য
মা-বাপ করেছেন, মা-বাপের স্নেহ
করেছেন তিনিই বুঝাবেন। তিনি এত
উপায় করেছেন, আর এ-উপায়
করবেন না? যদি বুঝাবার দরকার
হয় তিনিই বুঝাবেন। তিনি তো অন্তর্যামী। যদি ওই
মাটির প্রতিমাপূজা করাতে
কিছু ভুল হয়ে থাকে, তিনি
কি জানেন না -- তাঁকেই ডাকা
হচ্ছে? তিনি ওই
পূজাতেই সন্তুষ্ট হন। তোমার ওর
জন্য মাথা ব্যথা কেন? তুমি নিজের যাতে
জ্ঞান হয়, ভক্তি হয়, তার চেষ্টা কর।
এইবার তাঁহার অহঙ্কার
বোধ হয় একেবারে চূর্ণ
হইল।
তিনি ভাবিতে লাগিলেন, ইনি যা বলেছেন তাতো ঠিক! আমার বুঝাতে যাবার কি দরকার! আমি কি ঈশ্বরকে জেনেছি -- না আমার তাঁর উপর ভক্তি হয়েছে! “আপনি শুতে স্থান পায় না, শঙ্করাকে ডাকে!” জানি না, শুনি না, পরকে বুঝাতে যাওয়া বড়ই লজ্জার কথা ও হীনবুদ্ধির কাজ! একি অঙ্কশাস্ত্র, না ইতিহাস, না সাহিত্য যে পরকে বুঝাব! এ-যে ঈশ্বরতত্ত্ব। ইনি যা বলছেন, মনে বেশ লাগছে।
ঠাকুরের সহিত
তাঁহার এই প্রথম ও শেষ
তর্ক।
শ্রীরামকৃষ্ণ -- তুমি মাটির প্রতিমাপূজা বলছিলে। যদি মাটিরই হয়, সে-পূজাতে প্রয়োজন আছে। নানারকম পূজা ঈশ্বরই আয়োজন করেছেন। যার জগৎ তিনিই এ-সব করেছেন -- অধিকারী ভেদে। যার যা পেটে সয়, বা সেইরূপ খাবার বন্দোবস্ত করেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ -- তুমি মাটির প্রতিমাপূজা বলছিলে। যদি মাটিরই হয়, সে-পূজাতে প্রয়োজন আছে। নানারকম পূজা ঈশ্বরই আয়োজন করেছেন। যার জগৎ তিনিই এ-সব করেছেন -- অধিকারী ভেদে। যার যা পেটে সয়, বা সেইরূপ খাবার বন্দোবস্ত করেন।
“এক
মার পাঁচ ছেলে। বাড়িতে মাছ
এসেছে। মা মাছের নানারকম ব্যঞ্জন করেছেন
-- যার যা পেটে সয়! কারও
জন্য মাছের পোলোয়া, কারও
জন্যে মাছের অম্বল, মাছের
চড়চড়ি, মাছ ভাজা -- এই সব
করেছেন। যেটি যার
ভাল লাগে। যেটি যার
পেটে সয় -- বুঝলে?”
মাস্টার
-- আজ্ঞে হাঁ।
এবার দেখে নেই এই ঈশ্বর বলতে আমরা কি
বুঝি??? ঠাকুরের কথায় আমি ঈশ্বর কে জানার ক্ষুদ্র চেষ্টা করছি মাত্র, আপনারা কি
আছেন আমার সাথে??
চলুন তাহলে যাত্রা শুরু করা যাক...
ঈশ্বর শব্দটির সংস্কৃত ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে ঈশ্বর
শব্দটি হল ঈশ ধাতু বর প্রত্যয় যোগে নিস্পন্ন। ঈশ্বর
শব্দের মূল "ঈশ্" এর অর্থ হল,দক্ষ, মালিক,শাসক। দ্বিতীয় অংশ 'বর' যার আভিধানিক অর্থ হল
"সেরা, চমৎকার, সুন্দর, শাসক"। অতএব,
যুগপৎভাবে ঈশ্বর শব্দের অর্থ হল; সেরা বা সুন্দরের স্রষ্টা।তাহলে সামগ্রিক ভাবে
তার অর্থ এই দাঁড়াল যে যিনি সকলের কর্তা তিনিই ঈশ্বর, তিনি সকল কিছুর নিয়ন্তা। আবার তিনিই এই
সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর। যার কাছে সৃষ্টি,পালনও
সংহারের ভার ন্যস্ত। সময়কাল ও শাখাভেদে এর বহু অর্থ। তিনি অনন্তরূপী, অনন্ত গুণের অধিকারী। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের
ধর্মীয় বইয়ে ঈশ্বর এর নানাবিধ অর্থ, যেমন: সৃষ্টিকর্তা, মহান
সত্তা, পরমাত্মা, প্রভু, মহাবিশ্বের শাসক, ধনী শ্রেষ্ঠী ,একাদশ
রুদ্রের মধ্যে এক, স্বামী,দেবতা-শিব, দয়াময় এবং রক্ষাকর্তা।কোথাও পরমাত্মাকে আবার
কোথাও শাসক কে ঈশ্বর বলা হয়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রভুকেও ঈশ্বর শব্দের আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবার কোথাও বা এই ঈশ্বর ভগবান…পরমেশ্বর,… ইষ্টদেবতা বা যে কোন বিশেষ আত্মা, যা কালক্রমে ব্যক্তি ঈশ্বরের রূপ নিয়েছেন বলে পরিচিত।
শৈবধর্মে মহাদেবকেই ঈশ্বর
রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে,সেই জন্যে তিনি মহেশ্বর (মহা+ঈশ্বর)বা পরমেশ্বর (পরম+ঈশ্বর)। বৈষ্ণব
মতে ঈশ্বর হলেন বিষ্ণু বা নারায়ণ। ব্রাহ্মবাদে যেমন ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়,
নিরাকার রূপী পরম পিতা, ঠিক তেমনি ভক্তিবাদে
ঈশ্বর হলেন বহু দেব-দেবী, তিনি সাকার।
যোগ দর্শনে ঈশ্বর হলেন এক ব্যক্তিস্বরূপ অথবা আধ্যাত্মিক রূপে
চিহ্নিত সত্ত্বা, সেই রূপেই তাঁর সাধনা করা হয়।আবার অদ্বৈত বেদান্তে ঈশ্বর হলেন গিয়ে এক অদ্বৈতবাদী
সত্তা, যে জড়ের সাথে জীবের সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম।আমরা ঋগ্বেদে ঈশ্বর শব্দটি কিন্তু পাই
নি, তবে
ঈশ্ ক্রিয়াপদটি ঋগবেদে আছে, যার অর্থ কিছু করার সক্ষমতা
রাখা, যোগ্য। ঈশ্বর শব্দটি সামবেদ, অথর্ববেদ এবং যজুর্বেদ-এর সংহিতায় ও
পাওয়া যায় না। প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণবিদ পাণিনির মতে ঈশ্বর শব্দের আভিধানিক
অর্থ কিন্তু আবার সৃষ্টিকর্তা বা মহান সত্তা নয় ।
মহাযান বৌদ্ধধর্মে ঈশ্বর হলেন অবলোকিতেশ্বর অর্থাৎ এমন এক মহান সত্তা,যিনি জগতের সকলের দু:খ, কষ্ট অনুভব করেন এবং সেই হিসেবে পূজনীয়। তিনিই বোধিসত্ত্ব হিসেবে ভক্তগণের
কাছে আরাধ্য।
সনাতন ধর্মে আরেকটি বিশেষত্ব
আছে, এখানে ঈশ্বর শুধুমাত্র পুরুষই নয়, এখানে ঈশ্বর নারীরূপেও পূজিতা।
ইশ্বরের স্ত্রীলিঙ্গ ঈশ্বরী, যেমন দেখা যায় শাক্তধর্মে যেখানে কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা সকলেই নারী এবং সকলেই দেবীরূপে পূজিতা।
আমাদের সনাতন
ধর্মে সর্বমোট ছয়টি দর্শন, তার মধ্যে দুইটি হল সাংখ্য এবং মীমাংসা। যা ঈশ্বরকে স্বীকার করে না। বাকি যোগদর্শন, বৈশেষিক, বেদান্ত এবং ন্যায় নামক চারটি দর্শনে ঈশ্বর এর উল্লেখ পাওয়া যায় তবে প্রত্যেক দর্শনে ঈশ্বরের
ভিন্ন ভিন্ন অর্থরূপে আলোচিত।
পতঞ্জলির
যোগদর্শনে ঈশ্বর শুধু ব্যক্তি
স্রষ্টা নন,
তিনি
পরমাত্মা, তার প্রত্যেক জীবের উপর
অলৌকিক প্রভাব রয়েছে, ঈশ্বরকে এক বিশেষ
পুরুষ রূপে চিহ্নিত। তবে পতঞ্জলির ঈশ্বর এর ধারণা আর অদ্বৈতবাদের ঈশ্বরের ধারনা
কিন্তু এক নয়।
হিন্দুধর্মে
একটি বিশেষ দর্শন
হল বৈশেষিক। যা কণাদ এক সহস্র খ্রিস্টপূর্বে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই দর্শন অনুযায়ী পরমাণু বা বিশ্বজগৎ সৃষ্টিতে ঈশ্বরের প্রয়োজন
হয় নি। এই দর্শনের মুল কথা হল পরমাণুর সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, তা শাশ্বত। প্রাকৃতিক
নিয়ম অনুযায়ী এই পরমাণুর স্থানান্তর ঘটে, এর জন্য কোনো লৌকিক সত্তার
প্রয়োজন হয় না। এক
সহস্রবছর পরে ঈশ্বর সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণা এই বৈশেষিক দর্শনে প্রবেশ করে। এই
দর্শনের নানাবিধ বিবর্তন ঘটার পর, এই দর্শনের বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরমাণু এবং ঈশ্বর
শাশ্বত। তিনি সর্বজ্ঞ,
সর্বত্র
বিরাজমান। এই মতে
ঈশ্বর
বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেন নি, বরং তিনি সৃষ্টি করেছেন মহাবিশ্বের অদৃশ্য নিয়ম এবং
ধ্রুবক এবং এই নিয়ম গুলোর জন্য মহাবিশ্ব তার আপন নিয়মে চলতে থাকে। এবং তারপর
ঈশ্বর নিষ্ক্রিয় হয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। আর মহাবিশ্ব তার আপন গতিতে চলতেই থাকে।
অদ্বৈতবাদীর
ঈশ্বর মাধ্যমিকার "আদি বুদ্ধের" ন্যায়, নাস্তিক্যবাদী নয়। হিন্দুধর্মের
অন্যান্য দর্শনের ন্যায় অদ্বৈতবাদীরা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, কিন্তু বৌদ্ধরা আবার আত্মার
অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়।
ঈশোপনিষদে
ঈশ্বর নিয়ে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর
সবকিছুর উর্ধ্বে,
সবকিছুর
বাইরে, সবকিছু পেরিয়ে তথাপি
সবকিছুর অভ্যন্তরে বিরাজমান। যে ব্যক্তি নিজেকে জানে, তাকে কখনো কারো
সম্মুখে মাথা নত করার প্রয়োজন হয় না, সে হয় ভয়শূন্য, বিভ্রান্তি মুক্ত, এবং শয়তানের
কুদৃষ্টি থেকে মুক্ত।
সে ঠিক ঈশ্বরের মতই নির্মল,
অভেদ্য, শয়তানের প্রভাব থেকে
স্বাধীন।
সনাতন
ধর্মের দ্বৈতবাদে ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বৈতবাদে নারায়ণকে (বিষ্ণু) ঈশ্বর হিসেবে ভাবা হয়।
দ্বৈতবাদীদের
কাছে ঈশ্বর সম্পূর্ণ,
নিখুঁত
এবং উচ্চতর বাস্তবতারূপে বিদ্যমান। একই সাথে তাদের কাছে এই পৃথিবী সম্পূর্ণ
ভিন্ন-বাস্তবতারূপে বিদ্যমান। অর্থাৎ, লৌকিক এবং পারলৌকিক উভয়জগৎই
দ্বৈতবাদীদের কাছে বাস্তব। তবে একটি জগৎ আরেকটি জগৎ থেকে আলাদা। দ্বৈতবাদে
প্রতিটি জীবের আত্মা প্রত্যেকটি জীবের
জন্য স্বতন্ত্র,
এবং
সে আত্মা অন্য জীবের আত্মা থেকে ভিন্ন। আত্মা সবসময় মোক্ষ লাভ করতে চায়, আর এ মোক্ষ লাভের
উপায় হচ্ছে আত্মার পরমাত্মার (ঈশ্বর) সাথে লীন বা একাত্ম হয়ে যাওয়া।
মাধবাচার্য
জীবাত্মা এবং ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্যকে পাঁচটি উপায়ে বিন্যস্ত করেছেন। যথা: আত্মা
এবং ঈশ্বর দ্বৈত,
ঈশ্বর
এবং বস্তুর দ্বৈত,
আত্মা
এবং বস্তুর দ্বৈত,
একটি
আত্মার সাথে অপর আত্মার মধ্যে ভিন্নতা, এবং বস্তু-বস্তুতে দ্বৈততা। এই
ভিন্নতা গুণে এবং সংখ্যায় উভয়ক্ষেত্রেই বিদ্যমান অদ্বৈতবাদে মোক্ষ যা আত্মার পরমাত্মার সাথে
একাত্ম হয়ে যাওয়া তা ইহকালেই
লাভ করা যায়,
কিন্তু
দ্বৈতবাদে মোক্ষ লাভ করা যায় মৃত্যুর পরে, যদি ঈশ্বরের করুণা হয়। তবে
ঈশ্বরের কৃপাভিন্ন আত্মার মোক্ষ লাভ হয় না, তাই তাকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়, যতক্ষণ না মোক্ষলাভ হয়।
দ্বৈতবাদীদের
মতে এই বিশ্বজগৎ মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন।আত্মা তার সঠিক জ্ঞানের অভাবে ও অজ্ঞতার
কারণেই কষ্ট করে,
দুর্ভোগ
ভোগ করে, এবং তার ফলে তৈরী হয়
তার বন্ধন। এই
বন্ধন হয় মোক্ষলাভ পথের বাধা। সকল কিছু
ত্যাগ করে ঈশ্বরের আরাধনা করলেই একমাত্র আত্মার
মোক্ষলাভ সম্ভব বলে বিবরিত। ধার্মিক
জীবনযাপন করে ইহলোকে সাত্ত্বিক কর্ম করলে
ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় আত্মার মুক্তি ঘটে যায় বলেই দ্বৈতবাদীরা মনে করে থাকেন।
ন্যায়শাস্ত্রের
পণ্ডিতদের মতে ঈশ্বর হচ্ছেন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, অব্যর্থ, এবং এই বিশ্বচরাচর
ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষের কাজ যেমন, মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, ঠিক একইভাবে সৃষ্টির
উপস্থিতি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ দেয়।তারা ঈশ্বর নিয়ে নিজেদের মতে একটি
তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন। তাদের মতে ঈশ্বর হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা, যিনি আশীর্বাদ করেন, যিনি অন্নদায়ী ও মানুষের
আকাঙ্খা পূর্ণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে আবার ন্যায় বিশেষজ্ঞরাই এই তত্ত্বকে বাতিল
করে দেন এবং তাদের কার্যক্রমে ক্রমেই নাস্তিক্যবাদী ভাবনা ফুটে উঠে। এর
পরবর্তীতে ন্যায় শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা পুনরায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে ক্রমাগত
যুক্তি দেখিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষেই একমত হন।
মীমাংসা
দর্শনের পণ্ডিতরা আবার সঠিক প্রমাণ ও তথ্যের ভিত্তিতে কোনকিছুর সিদ্ধান্তে আসেন।তাই
মীমাংসা বিশেষজ্ঞদের মতে যদি ঈশ্বর এই
বিশ্ব সৃষ্টি করে থাকেন,
তাহলে
মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ পেত, কিন্তু বাস্তবে তো মানুষ ও তার আত্মাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। তাই
মীমাংসা বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, এই মহাজগৎ নিখুঁত নয় এবং আত্মার মোক্ষলাভের জন্য ঈশ্বরের
কোনো প্রয়োজন নাই।
দ্বৈতবাদ
এবং অদ্বৈতবাদ উভয় ধারণাই বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিতার ঈশ্বরের
মধ্যে দেখা যায়। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
বিশেষজ্ঞ রামানুজ ঈশ্বর
সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন,
ঈশ্বর ব্রহ্মের মতই এই সমগ্র বিশ্বচরাচরের
সৃষ্টিকর্তা।তিনিই
পরম কারণ, তিনি এই
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বিস্তৃত।বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীদের মতে ঈশ্বর পঞ্চরূপে বিস্তৃত
হতে পারেন, তিনি মহাবিশ্বজুড়ে
অবস্থান করেন। অবতাররূপে পৃথিবীতে অবস্থান করতে পারেন, জলের প্রবাহে অবস্থান
করেন, সকল জীবের অভ্যন্তরে
অবস্থান করেন এবং বিগ্রহের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ
বিশেষজ্ঞদের কাছে শ্রীবিষ্ণু অথবা তার অবতারই হলেন
ঈশ্বর।
আবার
অচিন্ত্য ভেদ-অভেদ (অচিন্ত্য শব্দের অর্থ হচ্ছে, চিন্তা করা যায় না
এমন; অর্থাৎ ধারণাতীত।
"ভেদ" শব্দের অর্থ হচ্ছে পার্থক্য, আর অভেদ শব্দের অর্থ হচ্ছে এক)
দর্শনে সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক থাকে এবং এই দর্শনের ঈশ্বর হলেন শ্রীকৃষ্ণ।
চার্বাক
দর্শনের অনুসারীরা বস্তুবাদী এবং এই দর্শনের মূলকথা হল, তাকেই বিশ্বাস করা
উচিত, যার পিছনে যুক্তি আছে।
তারা অতিপ্রাকৃত ঈশ্বর সংক্রান্ত সকল মতবাদকেই তারা খারিজ করে দিয়েছিলেন।
( বিভিন্ন তথ্যসুত্র থেকে সঙ্কলিত)
No comments:
Post a Comment