Saturday, 17 November 2018

শ্রীশ্রী জগদ্ধাত্রী মা--সঙ্কলক শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী



মা জগদ্ধাত্রীর পূজা কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এর উল্লেখ কাত্যায়নীতন্ত্রতে পাওয়া যায় দুর্গাকল্প বর্নিত এই যে
-দেবগণের হিত, দুর্বত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তিবিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী (জগদ্ধাত্রী) আবির্ভূতা হলেন
কালবিবেক গ্রন্থে পূজার বিধান প্রসঙ্গে শূলপাণি লিখছেন:
কার্তিকোঽমলপক্ষস্য ত্রেতাদৌ নবমেঽহনি

পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে নিষেদূষীম্।।
-ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে সিংহপৃষ্ঠে সমাসীনা দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা করিবে
জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা বলে বিবেচিতসপ্তমী, অষ্টমী নবমী এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে তবে অনেক স্থলে  নবমীর দিনেই তিন বার পূজা করে সপ্তমী, অষ্টমী নবমী পূজা সম্পন্ন হয়ে থাকেআবার অনেক ক্ষেত্রে প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন হয়ে থাকেদুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জন ও বিজয়াকৃত্য হয়ে থাকেপুষ্পাঞ্জলীর মন্ত্র দক্ষিনা-কালীর মন্ত্রের ন্যায় হলেও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্র দুর্গাপূজার মন্ত্রের ন্যায়

যদিও জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব বলে বিবেচিত তবুও  দুর্গা বা কালীপূজার ন্যায় এই পূজার প্রচলন তেমন নয় তবে আধুনিক কালে এই পূজার প্রচলন বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছেএই পূজার ইতিহাস বিচার করলে দেখা যায় যে আনুমানিক অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রথম প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা উত্তরতর বৃদ্ধি পায়  দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি পরিবারের অতি-পরিচিত এক দেবী, এর বিভিন্ন প্রমাণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়া যায়শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়, যা  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত  কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ারশান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয় তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকতো বলে জানা যায়
দেবীর রূপের বর্ণনা তাঁর ধ্যান মন্ত্রে আমরা পাই...... যা হলো......
সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্ 

চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্ 
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
ত্রিবলীবলয়োপেতনাভিনালমৃণালিনীম্
রত্নদ্বীপে মহাদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।।


- অর্থাৎ মহাদেবী জগদ্ধাত্রী সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া, নানা অলংকারে ভূষিতা নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী দেবীর বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ শার্ঙ্গধনু; দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র পঞ্চবাণ রক্তবস্ত্রপরিহিতা সেই ভবসুন্দরী প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা নারদাদি মুনিগণ তাঁর নিত্যসেবা করে থাকেন তাঁর ত্রিবলিবলয়সমন্বিত নাভিমণ্ডল মৃণালবিশিষ্ট পদ্মের ন্যায় সেই শিবপত্নী রত্নদ্বীপরূপ উচ্চ বেদিকায় স্থিত সিংহাসনে প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর উপবিষ্টা

নাগযজ্ঞোপবীতিনী জগদ্ধাত্রী; নাগরূপ যজ্ঞোপবীত মহাযোগিনী ব্রহ্মময়ী জগদ্ধাত্রীর প্রতীকজগদ্ধাত্রী দেবীর মূর্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “অর্ক বা সূর্যই বিশ্বের পোষণকর্তা পৃথিব্যাদি আবর্তনশীল গ্রহ-উপগ্রহদিগকে সূর্যই নিজের দিকে আকর্ষণ করে রেখেছেন দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যেও ধারণী পোষণী শক্তির পরিচয় বিদ্যমান তাই তাঁকে বলা হয়েছে বালার্কসদৃশীতনু একই কারণে জগৎপালক বিষ্ণুর শঙ্খ-চক্র-শার্ঙ্গধনু-আদি আয়ুধ দেবীর শ্রীকরে... দেবীর রক্তবস্ত্র রক্তবর্ণের মধ্যে, দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে সেই রজোগুণেরই ছড়াছড়ি রজোদীপ্ত বলেই জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিময়ী তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, তাঁর বাহন সকলই তাঁর শক্তিমত্তার ভাবটি আমাদের অন্তরে উদ্দীপ্ত করে দেয় তবে দেবীর এই বীর্য সংহারের নয় পরন্তু সমগ্র বিশ্বকে মহাসর্বনাশ থেকে রক্ষাপূর্বক তাকে আত্মসত্তায় ঋতে সত্যে সুস্থির করে রাখবার জন্য ... নাগ বা সর্প যোগের পরিচায়ক উপবীত ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতীক দেবী জগদ্ধাত্রী ব্রহ্মময়ী; তিনি পরমা যোগিনী মহাযোগবলেই ব্রহ্মময়ী ধরে আছেন এই নিখিল বিশ্বসংসারকে এই জগদ্ধারণই জগদ্ধাত্রীর পরম তপস্যা তাঁর নিত্য লীলা, তাঁর নিত্য খেলা জননীরূপে তিনিই বিশ্বপ্রসূতি, আবার ধাত্রীরূপে তিনিই বিশ্বধাত্রী
জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ খুঁজলে আমরা দেখি যে এই শব্দের অর্থ হলো জগৎ+ধাত্রী অর্থাৎ জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)” ব্যাপ্ত অর্থে দুর্গা, কালী সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রীতবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পশ্চাতে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন স্বামী প্রমেয়ানন্দের মতে,
ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি জগদ্ধাত্রী সগুণ ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি বিনাশরূপ তিনগুণের যুগপৎ প্রকাশ যেমন কালীরূপের বৈশিষ্ট্য, তাঁর ধারণী পোষণী গুণের যুগপৎ প্রকাশও জগদ্ধাত্রীরূপের বৈশিষ্ট্য... ধা ধাতুর অর্থ ধারণ বা পোষণ ভগবতী নিখিল বিশ্বকে বক্ষে ধারণ করে পরিপালন করেন বলে মুনিগণ কর্তৃক তিনি ত্রৈলোক্যজননী নামে অভিহিত... নিয়ত-পরিবর্তনশীল এই জগতের পেছনে রয়েছে তার রক্ষণ পোষণের জন্য অচিন্তনীয়া মহাশক্তির এক অদ্ভুত খেলা সতত পরিবর্তনশীল জগৎ সেই মহাশক্তির দ্বারা বিধৃত যিনি নিত্যা, শাশ্বতী অপরিবর্তনীয়া দেবী জগদ্ধাত্রীই সেই ধৃতিরূপিণী মহাশক্তি
কেন উপনিষদে বর্ণিত একটি উপাখ্যান অনুসারে : একবার দেবাসুর সংগ্রামে দেবগণ অসুরদের পরাস্ত করলেন কিন্তু তাঁরা বিস্মৃত হলেন যে নিজ শক্তিতে নয়, বরং ব্রহ্মের বলে বলীয়ান হয়েই তাঁদের এই বিজয় ফলত তাঁরা হয়ে উঠলেন অহংকার-প্রমত্ত তখন ব্রহ্ম যক্ষের বেশ ধারণ করে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন তিনি একটি তৃণখণ্ড দেবতাদের সম্মুখে পরীক্ষার নিমিত্ত রাখলেন অগ্নি  বায়ু তাঁদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও সেই তৃণখণ্ডটিকে দগ্ধ বা বিধৌত করতে পারলেন না তখন দেবগণ ইন্দ্রকে যক্ষের পরিচয় জানবার নিমিত্ত প্রেরণ করলেন ইন্দ্র অহংকার-প্রমত্ত হয়ে যক্ষের কাছে আসেননি, এসেছিলেন জিজ্ঞাসু হয়ে তাই ব্রহ্মরূপী যক্ষ তাঁর সম্মুখ হতে তিরোহিত হলেন বরং তাঁর সম্মুখের আকাশে দিব্য স্ত্রীমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন হৈমবতী উমা উমা ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে ইন্দ্রের জ্ঞানপিপাসা নিবৃত্ত করলেন
কিন্তু  কাত্যায়নী তন্ত্র নামক
উপনিষদে উমার কোন রূপবর্ণনা নেই কেবলমাত্র তাঁকে হৈমবতী অর্থাৎ স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা বলা হয়েছে তবে এই হৈমবতী উমাই যে দেবী জগদ্ধাত্রী সে প্রত্যয় জন্মে কাত্যায়ণী তন্ত্রের ৭৬ পটলে (অধ্যায়) উল্লিখিত একটি কাহিনি থেকে এই কাহিনি অনুসারে : একদা ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু  চন্দ্র – এই চার দেবতা অহংকার-প্রমত্ত হয়ে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করলেন তাঁরা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই মহাশক্তির শক্তিতেই তাঁরা বলীয়ান দেবগণের এই ভ্রান্তি অপনয়নের জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন এর পরের কাহিনি কেন উপনিষদে বর্ণিত তৃণখণ্ডের কাহিনির অনুরূপ দেবী প্রত্যেকের সম্মুখে একটি করে তৃণখণ্ড রাখলেন; কিন্তু চার দেবতার কেউই তাকে স্থানচ্যুত বা ভষ্মীভূত করতে অসমর্থ হলেন দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন তখন দেবী তাঁর তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন এই মূর্তি ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা, রক্তাম্বরা, সালংকারা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিনী দেব-ঋষিগণ কর্তৃক অভিবন্দিতা এক মঙ্গলময়ী মহাদেবীর মূর্তি সমগ্র জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে দেবী দেবগণকে এই মূর্তি দেখালেন; দেবগণও তাঁর স্তবে প্রবুদ্ধ হলেন 
সর্বশেষে দেবী জগদ্ধাত্রীকে তাঁর স্তব মন্ত্রে প্রণাম জানিয়ে আমি এই সঙ্কলিত তথ্যটি সমাপ্ত করছি মা আনন্দময়ী সকলকে আনন্দে রাখুন এই প্রার্থনা করি
শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী স্তব...

ওঁ আধারভূতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধরে
ধ্রূবে ধ্রূবপদে ধীরে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে
শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে
জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
পরমাণু স্বরূপে দ্ব্যণুকাদি স্বরূপিণি
স্থূলাতি সূক্ষ্ম রূপেণ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম রূপে প্রাণাপানাদিরূপিণি
ভাবাভাব স্বরূপে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
কালাদি রূপে কালেশে কালাকাল বিভেদিনি
সর্ব্ব স্বরূপে সর্ব্বজ্ঞে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
মহাবিঘ্নে মহোৎসাহে মহামায়ে বলপ্রদে
প্রপঞ্চাসারে সাধ্বীশে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
অগম্যে জগতামাদ্যে মাহেশ্বরি বরাঙ্গনে
অশেষ রূপে রূপস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
দ্বিসপ্তকোটি মন্ত্রাণাং শক্তিরূপে সনাতনি
সর্ব্ব শক্তি স্বরূপে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
তীর্থযজ্ঞ তপোদান যোগসারে জগন্ময়ি
ত্বমেব সর্ব্বং সর্ব্বস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
দয়ারূপে দয়াদৃষ্টে দয়াদ্রে দুঃখমোচনি
সর্ব্বাপত্তারিকে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
অগম্য ধামাধামস্থে মহাযোগীশ হৃৎপুরে
অমেয় ভাব কূটস্থে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে
যঃ পঠেৎ স্তোত্রমেতত্তু পূজান্তে সাধক উত্তমঃ
সর্ব্ব পাপৎ বিনির্মুক্তঃ পূজা ফলং অবামুয়াৎ

ইতি শ্রীজগদ্ধাত্রীকল্পে জগদ্ধাত্রী স্তোত্রং সমাপ্তম্


Sunday, 4 November 2018

ধনতেরাস












ধনতেরাস
সংকলকঃ শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত ধনতেরাস আসলে আর কিছু নয় ধনাত্রয়োদশী বা ধনবত্রী ত্রয়োদশী। আমাদের সনাতন ধর্মের চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে কার্ত্তিক মাসের তেরোতম দিন অর্থাৎ ত্রয়োদশী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। এর নেপথ্যে পুরাণের মধ্যেই অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন
পুরাণে আছে হিম রাজা ও তাঁর ষোলো বছরের পুত্রের কাহিনী।
রাজপুত্রের কোষ্ঠী অনুসারে রাজপুত্রের বিয়ের পরেই সাপের কামড়ে মৃত্যু যোগ ছিলো। যেমনটা আমরা মনসামঙ্গলে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের গল্পে পাই। এই ব্যাপারটি নব-বধুর কানে আসতেই বিয়ের রাতে সেই নববধু রত্নালঙ্কারের জৌলুসে যমের সঙ্গী সাপের চোখ ধাঁধিয়ে রাখার জন্যে ধনরত্ন, নুতন বাসন সামগ্রী বাসর ঘরের প্রবেশ দ্বারে সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেই বিস্বাসে আজও নিজের ঘর ও পরিবার পরিজনদের সুরক্ষিত রাখতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধনতেরাস উদযাপন করা হয় আর সন্ধ্যাতে যে দীপ জ্বালানো হয় তাকে বলা হয় যমদীপদান।
আবার আরেক পুরাণে আছে, 
একসময় দুর্বাসা মুনির অভিশাপে ধন ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী শ্রীহীন ও গৃহহারা হয়ে যান যার ফলে সমগ্র স্বর্গরাজ্যে অন্ধকার নেমে আসে, এরপর যখন দেবতারা অসুরদের সাথে সমুদ্রমন্থন করেন সেই সময় স্বর্গের দেবী মা লক্ষ্মীকে ফিরে পেয়েছিলেন আর সেই দিন ছিলো কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী, সে থেকে এই তিথিতে ধনতেরাস পালিত হয়, ধন সৌভাগ্যাদির আশায়।

......আবার পুরাণের আরেক গল্পে আছে, ইন্দ্রের অভদ্র আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মহর্ষি দুর্বাসা তিন লোককে শ্রীহীন হওয়ার অভিশাপ দেন। এর ফলে পৃথিবী থেকে নিজের লোকে গমন করেন অষ্টলক্ষ্মী। জগৎ সংসারে শ্রী প্রতিষ্ঠার জন্য সমুদ্র মন্থনের পরামর্শ দেন শিব। দেবতা ও অসুরেরা মিলে তখন সমুদ্র মন্থন করছিলেন আর সেই সমুদ্র মন্থনের সময় হাতে অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হয়েছিলেন এই তিথিতেই। কথিত, সমুদ্র মন্থনের ফলে চৌদ্দটি প্রমুখ রত্নের উৎপত্তি হয়। চতুর্দশ রত্ন হিসেবে স্বয়ং অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হন। আর সেইদিনই পালিত হয় ধনতেরাস আর এর ঠিক দুদিন পর প্রকট হন মহালক্ষ্মী। তাই ধনতেরাসের দুদিন পর দীপাবলীতে মহালক্ষ্মী পুজো করা হয়।
বিষ্ণু ধন্বন্তরীকে দেবতাদের বৈদ্য এবং বনস্পতি ও ঔষধির অধিপতি নিযুক্ত করেন। তাঁর আশীর্বাদেই সমস্ত বৃক্ষ ও বনস্পতির মধ্যে রোগনাশক শক্তির সঞ্চার হয় বলে বিশ্বাস।
সমুদ্র মন্থনের সময় শরৎ পূর্ণিমায় চাঁদ, কার্তিক দ্বাদশীর দিনে কামধেনু, ত্রয়োদশীর দিনে ধন্বন্তরী ও অমাবস্যার দিনে মহালক্ষ্মীর উৎপত্তি হয়। জনকল্যানের জন্য ধন্বন্তরীই অমৃতময় ঔষধির খোঁজ করেন। তাঁর বংশেই শল্য চিকিৎসার জনক দিবোদাস জন্ম গ্রহণ করেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র সুশ্রুত তাঁর শিষ্য ছিলেন যিনি আয়ুর্বেদের মহানতম গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতার রচনা করেন।
স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এইদিনে ধন্বন্তরীর উপাসনা করা হয়। এদিন ধন- সমৃদ্ধির জন্য কুবেরেরও পুজো করা হয়। পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী, ধনতেরাসের দিনে বিধি মেনে পুজো করলে ও দীপ দান করলে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে নিশ্চিত মুক্তি পাওয়া যায়।
অপর এক পৌরাণিক গল্প অনুসারে:
এক সময় ভগবান বিষ্ণু নরলোকে বিচরণ করতে এলে, লক্ষ্মীও তাঁর সঙ্গ নেন। লক্ষ্মী স্বভাবত চঞ্চলা তাই তখন বিষ্ণু বলেন, তাঁর কথা মেনে চললেই লক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে যেতে পারেন। সেই শর্তে রাজী হয়ে লক্ষ্মী বিষ্ণুর সঙ্গে পৃথিবীতে আসেন।একটি স্থানে এসে বিষ্ণু লক্ষ্মীকে অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন এবং তাঁর না-আসা পর্যন্ত লক্ষ্মী যেন সেখান থেকে কোথাও না-যান। লক্ষ্মীর মনে দক্ষিণ দিকে বিষ্ণুর গমনের কারণ জানার কৌতূহল জাগ্রিত হয়। এর পর তিনিও বিষ্ণুর পিছু নেন। কিছু দূর এগোনোর পর সরষের খেতে ফুল ফুটে থাকতে দেখে, সেই ফুল দিয়ে লক্ষ্মী শৃঙ্গার করেন ও তার পর ফের অগ্রসর হন। কিছু দূর যাওয়ার পর ইক্ষুর খেত থেকে ইক্ষু তুলে তার রস পান করেন। সে সময় বিষ্ণু সেখানে আসেন ও লক্ষ্মীকে দেখে ক্ষুব্ধ হন। এর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে অভিশাপ দেন। বলেন, বারণ সত্ত্বেও লক্ষ্মী তাঁর পিছু নেন ও দরিদ্র কৃষকের খেত থেকে চুরির অপরাধ করে বসেন। লক্ষ্মীকে বারো বছর পর্যন্ত কৃষকের সেবা করতে বলে ক্ষীরসাগরের উদ্দেশে প্রস্থান করেন বিষ্ণু। সেইসময় একদিন লক্ষ্মী কৃষকের স্ত্রীকে স্নান করে লক্ষ্মী পুজো ও তার পর রান্না করার কথা বলেন। পুজোর পর কৃষক-পত্নীর সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হবে বলে জানান লক্ষ্মী। কৃষক-পত্নী তেমনই করেন। ফল স্বরূপ দ্বিতীয় দিনই কৃষকের ঘর অন্ন, রত্ন, ধনে ভরে যায়।
এভাবে ১২ বছর পর্যন্ত আনন্দে কাটে কৃষকের সময়। বারো বছর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিতে এলে কৃষকের স্ত্রী তাঁকে যেতে দেন না। তখন বিষ্ণু জানান, লক্ষ্মীকে কেউ যেতে দিতে চায় না। লক্ষ্মী চঞ্চলা, কোথাও টিকতে পারেন না। তখন লক্ষ্মী ওই কৃষককে জানান, তাঁর কথা মতো চললে, পরিবারে কখনও অর্থাভাব থাকবে না। ধনতেরাসের দিনে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করার কথা বলেন লক্ষ্মী। এর পর রাতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে সন্ধাকালে পুজো করতে বলেন। লক্ষ্মী কৃষককে বলেন, একটি রুপোর ঘটে তাঁর জন্য টাকা ভরে রাখতে। তিনি সেই ঘটেই অবস্থান করবেন।

আবার অপর একটি প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, রাজা বলির ভয় থেকে দেবতাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বিষ্ণু বামন অবতার নেন। এর পর তিনি বলির যজ্ঞ স্থলে পৌঁছন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য বামন রূপী বিষ্ণুকে চিনে ফেলেন। রাজা বলিকে শুক্রাচার্য সাবধান করে বলেন যে, বামন রূপে বিষ্ণু সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তাই বামন যা চাইবে, তা যেন দেওয়া না-হয়। কারণ বামন রূপী বিষ্ণু দেবতাদের সহয়াতার জন্য সেখানে প্রকট হয়েছেন। কিন্তু শুক্রাচার্যের কথা অমান্য করে বামন রূপী হরির প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বামনের তিন পা সমান ভূমি দান করতে রাজি হয়ে যান। শুক্রাচার্য এই দান বিফলে যাওয়ার জন্য লঘু রূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কমণ্ডলে প্রবেশ করেন। বামনও শুক্রাচার্যের ছল বুঝতে পেরে নিজের হাতে থাকা কুশকে কমণ্ডলে এমন ভাবে প্রবেশ করান, যার ফলে শুক্রাচার্যের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। 

এর পর বলি বামনকে তিন পা সমান জমি ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। বামন নিজের একটি পা দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথিবী ও অপর পা দিয়ে অন্তরীক্ষ মেপে নেন। কিন্তু তৃতীয় পা রাখার জন্য কোনও স্থান বেঁচে না-থাকার কারণে রাজা বলি নিজের মস্তক বামন রূপী বিষ্ণুর পায়ের তলায় রেখে দেন। এ ভাবে দেবতারা বলির ভয় থেকে মুক্তি পায়। এই জয়ের উৎসব হিসেবে ধনতেরাস পালিত হয়।

 ধনতেরাসের শুভ লগ্নে সমৃদ্ধি কামনায় গৃহস্থ বাড়িতে কেনা হয় মূল্যবান ধাতু ৷ সমৃদ্ধি লাভের জন্যই ধাতু কেনার প্রচল এই সময় ৷ তার এক প্রচলিত গল্প আছে...।।

কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে ধন্বন্তরীর জন্ম। সাগর মন্থনের সময় লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছিলেন ধন্বন্তরীও. ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, কিন্তু তাঁর কৃপা পাওয়ার জন্য সুস্থ জীবন ও দীর্ঘ আয়ু দরকার। সাংসারিক সুখ-সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্যের কামনার জন্য ধন্বন্তরীর ও  পুজো করা হয় এদিন।ধন্বন্তরী যখন সমুদ্র মন্থনের সময় প্রকট হয়েছিলেন, তখন তাঁর হাতে ছিল অমৃত কলস। আর সেই কারণে ধনতেরাসের সময় বাসন কেনার চল রয়েছে বলে মনে করা হয়, ধনতেরাসের সময় সোনার বা অন্য কোনও ধাতুর গয়না কিনলে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়  শাস্ত্রমতে, এই সময় নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী, যেকোনও শুদ্ধ ধাতুই কেনাই মঙ্গলজনক ৷এইদিনে সোনা কেনার চল আছে৷ সোনা না পারলে রুপো বা অন্য কোনও ধাতুও কিনতে দেখা যায়৷ ফলে অনেককে ধনতেরাসের দিনে বাসন কিনতেও দেখা যায়
তবে জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে, বিভিন্ন রাশির জন্য বিভিন্ন ধাতু কেনা উচিত ৷তবেই ধনতেরাস এর প্রকৃত ফললাভ সম্ভব। রাশি অনুযায়ী যেগুলির নির্দেশ আছে তা হল......
মেষ রাশি : সোনা কিনুন ৷ সোনা রাখুন লক্ষ্মীর সামনে ৷
বৃষ রাশি : সোনা ও রুপো কিনে ঠাকুর ঘরে রাখুন৷
মিথুন রাশি : সোনা নতুবা রুপো কিনতে পারেন ৷
কর্কট রাশি : ধনতেরাসে কিনতে পারেন পিতল ৷
সিংহ রাশি : সোনা বা পিতল কিনতে পারেন ৷
কন্যা রাশি : সোনা কিনে রাখুন ঠাকুর ঘরে।
তুলা রাশি : সোনা বা রুপো কিনুন।
বৃশ্চিক রাশি : পিতল কিনুন৷
ধনু রাশি : রুপো কিনুন।
মকর রাশি : রুপো কিনে  রাখুন ঠাকুর ঘরে 
কুম্ভ রাশি :পিতল কিনুন৷
মীন রাশি :  রুপোর কিছু কিনে ঠাকুর ঘরে রেখে দিন ৷
সংসারে সুখ ও শান্তি বজায় রাখতে এদিন অনেকের বাড়িতেই লক্ষ্মী ও গণেশের পুজো করা হয়. ধনতেরাসের দিনে ঘরে প্রদীপ জ্বালাতে হয়. বলা হয়, কৃষ্ণপক্ষের এই তিথিতে যমের নামে পুজো দিলে অকালমৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার  ধনতেরাসের দিন অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অর্থবর্ষের সূচনা হয়; তাই সেই দিন অনেকে নতুন বাসন, গয়না প্রভৃতিও কিনে থাকেন এই দিনে। 
উত্তর ও পশ্চিম ভারতের প্রভাবে গত কয়েক বছর ধরে বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরেও  ধনতেরাস উৎসবের প্রচলন দেখা যাচ্ছে৷ তাই তো ধনতেরাসের দিন সোনার দোকানে-দোকানে বাঙ্গালীদেরও অনেক ভিড় জমাতে দেখা যায়৷অনেকের কাছে বাঙ্গালীদের এইসব আচরন আদিখ্যেতা মনে হলেও আমার কিন্তু মন্দ লাগে না, দৈনন্দিন নানা ঝামেলা ও অশান্তির মধ্যে এই সকল দিয়ে যদি একটু মানসিক শান্তির খোঁজ চলে তবে মন্দ কি? আজকাল  তো অনুকরনের যুগ সকল ব্যাপারেই অনুকরন চলছে......  তবে সেই সকল অনুকরন ভালো যে গুলো সমাজের জন্যে ইতিবাচক বার্তা বয়ে নিয়ে আসে...... তাই নয় কি? যদিও আমার ঘরে তেমন কিছু এখনো শুরু হয় নি.........    
(সংগৃহীত)

Sunday, 14 October 2018

নবরাত্রি- শুভ পঞ্চমী তিথি-- দেবী স্কন্দমাতা

Image result for স্কন্দমাতা

 আজ নবরাত্রির পঞ্চম দিন, আজ দেবীর পঞ্চমী বিহিত রূপ হল দেবী স্কন্দমাতা। আজকের এই পূণ্যলগ্নে  সকল কে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।

সিংহাসনগতা নিত্যং পদ্মাশ্রিতকরদ্বয়া।
শুভদাস্তু সদা দেবী স্কন্দমাতা যশস্বিনী।।

মাতা দুর্গার পঞ্চম রূপটি স্কন্দমাতা নামে পরিচিত। হয়।দেবাদিদেব মহাদেবের পুত্র হলেন কার্ত্তিক । কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ । ইনি দেবাসুর সংগ্রামে দেবতাদের সেনাপতি ছিলেন। পুরাণাদিতে এঁকে কুমার এবং শক্তিধর বলে এঁর মাহাত্ম্যের বর্ণনা করা হয়েছে। স্কন্দের বাহন ময়ূর, তাই এঁকে ময়ূরবাহনও বলা ভগবতী পার্বতী সেই মহামায়ার একটি রূপ । তাই তিনি স্কন্দের মা অর্থাৎ দেবীর একটি রূপ স্কন্দমাতা নামে পূজিতা । পুরাণাদি তে এই দেবীকে স্কন্দের শক্তি হিসাবে বর্ণনা করা আছে । অর্থাৎ কৌমারী দেবী ও স্কন্দমাতা এক । কোন স্থানে স্কন্দমাতার বাহন ময়ূর ।
দেবী স্কন্দমাতার কথা জানা যায় স্কন্দ পুরাণ থেকে। অসুররাজ তারক বরলাভ করেছিল, কেবল শিব ও দুর্গার পুত্রই তার প্রাণবধে সক্ষম হবে। তাই দেবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সে সহজেই দেবতাদের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্য কেড়ে নিতে পেরেছিল। এই ঘটনার ঠিক আগেই সতী দেহত্যাগ করেছিলেন, শিবও হয়েছিলেন ধ্যানমগ্ন। তাই দেবতারা দুর্গাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করার অনুরোধ করলেন। দুর্গা শৈলপুত্রী রূপে গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে জন্ম নিলেন। তারপর ব্রহ্মচারিণী রূপে শিবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য করলেন কঠোর তপস্যা। শেষে শিবের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হল। তারপর যথাসময়ে জন্ম হল শিব ও দুর্গার পুত্র কার্তিকের। কার্তিকের জন্মের বিবরণ নানা পুরাণে নানাভাবে বর্ণিত হয়েছে। সে সবের উল্লেখ এখানে না করলেও চলবেশুধু এটুকু বলে রাখি, কার্তিকের ছিল ছয়টি মাথা। তাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ষড়ানন নামে। এই ষড়ানন স্কন্দই তারককে যুদ্ধে পরাজিত করে দেবতাদের স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্কন্দ ও স্কন্দমাতা উভয়েই তারকাসুর বধে দেবতাদের সাহায্য করেছিলেন বলে, মাতাপুত্রের পূজা একসঙ্গে করাই নিয়ম।
নবরাত্রি পূজার পঞ্চম দিনে এঁর আরাধনা করা হয়। সাধকের মন এই দিন বিশুদ্ধ চক্রেঅবস্থান করে।
এঁর বিগ্রহ মূর্তিতে দেখা যায় ভগবান স্কন্দ বালকরূপে এঁর ক্রোড়ে অবস্থান করছেন। স্কন্দমাতৃস্বরূপিণী দেবী চতুর্ভুজা। তিনি দক্ষিণের ওপরের হাতে স্কন্দকে ধরে আছেন এবং নিচের হাতটিকে উপরদিকে করে, তাতে পদ্মফুল নিয়েছেন। বামের উপরিস্থিত হাতটি নিচে নেমেছে বরাভয় মুদ্রারূপে আর নিচের হাতটি উপরে রয়েচে, পদ্মফুল ধারণ করে। স্কন্দমাতা সর্বাঙ্গে শুভ্রবর্ণা এবং পদ্মের উপর উপবিষ্টা, সেইজন্য এঁকে পদ্মাসনা দেবীও বলা হয়। ইনি সিংহকেও বাহনরূপে রাখেন।
নবরাত্র পূজার পঞ্চম দিনের কথায় শাস্ত্রে পুষ্কল মাহাত্ম্য বলা আছে। এই চক্রে চিত্তপ্রতিষ্ঠ সাধকের সমস্ত বাহ্য ক্রিয়া এবং চিত্তবৃত্তি লুপ্ত হয়ে যায়। তিনি বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাঁর মন সকল প্রকার লৌকিক, সাংসারিক, মায়িক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পদ্মাসনা মাতা স্কন্দমাতার স্বরূপে সম্পূর্ণভাবে লীন হয়ে যায়। এই সময় সাধককে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে সাধন পথে চলতে হয় এবং সমস্ত ধ্যান-বৃত্তিকে একাগ্র করে যোগপথে অগ্রসর হতে হয়।
মাতা স্কন্দমাতার আরাধনা করলে ভক্তের সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়। এই মর্ত্যলোকেই সে পরম শান্তি ও সুখের অনুভব করতে থাকে। মোক্ষের দ্বার তার কাছে নিজে থেকেই সুলভ হয়ে যায়। স্কন্দমাতার উপাসনা করলে বালকরূপ স্কন্দ ভগবানের আরাধনাও স্বতঃই হয়ে যায়। এই বৈশিষ্ট্য শুধু এঁরই আছে। সুতরাং সাধকের স্কন্দমাতার উপাসনায় বিশেষ লক্ষ্য দেওয়া উচিত। সূর্যমণ্ডলের অধিষ্ঠাত্রি দেবী হওয়ায় তাঁর উপাসকগণ অলৌকিক তেজ ও কান্তিসম্পন্ন হন। এক অলৌকিক প্রভামণ্ডল অদৃশ্যভাবে সর্বদাই তাদের চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত থাকে। এই প্রভামণ্ডল সর্বক্ষণ সাধকদের যোগক্ষেম বহন করে।
অতএব আমাদের একাগ্রভাবে মনকে পবিত্র রেখে মায়ের শরণাগত হওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত। এই ঘোর ভবসাগরের দুঃখ হতে মুক্তিলাভ করে মোক্ষের পথ সহজ করার এর থেকে উত্তম উপায় নেই।


কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...