Saturday, 5 August 2023

শ্রাবণ মাস মানেই কি দুধ অপচয়ের সময়!!! না...জানুন সত্যটা

 

 

হে জনদরদী, পরিবেশ দরদী মানবসকল খানিক সময় নিয়ে আমার এই প্রতিবেদন পড়ে দেখুন কিছু সত্যতা হয়তো এর মধ্যেও আছে, দেবাশীষ চক্রবর্ত্তীর এই লেখা পড়ে আপনাদের ধারণা যদি কিঞ্চিৎ বদলায় তবে আমার এই পরিশ্রম সার্থক। আমি কোন জ্ঞানীপন্ডিত নই আমি নিতান্ত সামান্য এক মানুষ, আর আমি  আমার ধারণা ও উপলব্ধির সহায়তায় লিখেছি এই বিষয় বস্তু……

প্রতিবারই শ্রাবণ মাস আসলে সকলের দুধের অপচয়ের কথা, অনাথ,দরিদ্র ও রোগীদের কথা মনেহয় আবার এই মাস ফুরোলে সেই বিষয় আবার একবছরের জন্যে স্তিমিত থাকে। ঠিক তেমনই কালীপুজা ও দেওয়ালীতে আমাদের পরিবেশ দুষণের জন্যে হৃদয় ব্যাকুলিত হয়ে উঠে……দোল্পুর্ণিমা বা হোলিতে রঙ খেলার সময় ‘জলের আরেক নাম জীবন জল বাঁচান , পরিবেশ বাঁচান’ এই কথা খুব মনে পরে বাদ বাকী সময় তা কিন্তু খুব একটা মনে পরে না।

এবারে আসি শ্রাবণ মাসে দুধের অপচয় বিষয় নিয়ে, বাকী গুলো না হয় সময়ে বলবো এই আবেগ গুলো তো seasonal, season শেষ আবেগ ও শেষ। শ্রাবণ মাসে কিছু জিনিস খাওয়ার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে আমাদের আয়ুর্বেদে, আয়ুর্বেদ অনুসারে,  এই চতুর্মাসে শাক-পাতার সাথে সাথে দুধ বা দুধ জাতীয়  যেমন দই, রায়তা ইত্যাদি খাওয়া নিষিদ্ধ করা আছে । শ্রাবণ মাসে এসব খাবার থেকে অনেক প্রকার  রোগের প্রকোপে পরতে হবে। শ্রাবণ মাসে দুধ বা দই দিয়ে তৈরি কিছু খাওয়া উচিত নয়। এতে করে অনেক ধরনের রোগের সম্মুখীন হতে পারেন। এর পাশাপাশি কাঁচা দুধ খাওয়াও এড়িয়ে চলতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাসে বলা হয়েছে যে শ্রাবণ মাসে ভগবান শিবকে কাঁচা দুধ নিবেদন করা হয়, তাই এই মাসে কাঁচা দুধ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত জিনিস খাওয়া নিষিদ্ধ। দই তৈরিতে দুধ ব্যবহার করা হয়, তাই শ্রাবণ মাসে দই বা দুধ এবং দই সম্পর্কিত জিনিস খাওয়া নিষিদ্ধ। শ্রাবণ মাসে অধিক বৃষ্টি হয়, এর ফলে সকল আনাচেকানাচে  ঘাস জন্মাতে শুরু করে এবং এর সাথে  অনেক ধরনের বিষাক্ত  পোকামাকড় এই সকল ঘাস-লতা-পাতাতে আশ্রয় নেয়। সেই সকল বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ ঘাসের সাথে  গরু-মহিষএর শরীরে প্রবেশ করে, যা তাদের দুধের মধ্যে প্রভাব ফেলে। তাই সেই সকল  দুধ স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও উপকারী নয় বরঞ্চ অপকারী। অনেকে আবার আয়ুর্বেদ বিশ্বাস করেন না, তাদেরকে জানাই অনেক ডাক্তারেরাও  এই ঋতুতে দুধ এবং দই সম্পর্কিত বস্তু  খাওয়া নিষিদ্ধ বা যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করার পরামর্শ করেন। এই সময়ে দই খেলে পরিপাকতন্ত্রের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে কারণ দইয়ে অ্যাসিড থাকায় নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। আয়ুর্বেদ অনুসারে, শ্রাবণ মাসে হজম প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়, এমন পরিস্থিতিতে দই এবং দই জাত যে কোন পদার্থ আমাদের  হজমে অসুবিধা সৃষ্টি  করতে পারে। এই ব্যাপারে ৩১/০৭/২০২৩ তে প্রকাশিত মেডিকভার হস্পিটালের একটি প্রতিবেদন  পড়ে দেখতে পারেন, লিঙ্ক টা দিলাম

https://www.medicoverhospitals.in/articles/foods-to-avoid-in-rainy-season#:~:text=Dairy%20products%2C%20especially%20unpasteurized%20milk,dairy%20products%20from%20reliable%20brands.

এইবার আসি ধর্মীয় বিশ্বাস কি বলে……

সেই জন্যেই হয়তো প্রাচীন কালে এই শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় বা শিবলিঙ্গের উপর দুধ ঢালার প্রচলন করা হয়। এবারে প্রশ্ন করতে পারেন কেন শিবকে সেই বিষাক্ত দুধ ঢালা হবে? আশাকরি সমুদ্র মন্থনের সেই পৌরাণিক কাহিনী সকলেই জানেন, সেই সময় অমৃত নির্গত হওয়ার পুর্বে নির্গত হয়েছিল সেই প্রাণনাশি গরল বা বিষ, এর প্রভাবে যখন প্রকৃতি নাশের সম্মুখীন তখন দেবতাদের অনুরোধে দেবাদিদেব মহাদেব সেই গরলকে আকন্ঠ পান করে বিশ্বকে রক্ষা করেন আর সেই থেকে তাঁর নাম হয় নীলকন্ঠ। এবারে শ্রাবণ মাসে এই বিশ্বাসে শিবের মাথায় দুধ ঢালা হয় যাতে শিব দুধের সেই সব বিষাক্ত প্রভাব দুর করে প্রকৃতিকে রক্ষা একমাত্র শিবই করতে পারেন।

তবে এ খবরে হয়তো অনেকের মনে কিছু আশ্বাস পেতে পারেন, শিবের মাথায় ঢেলে দেওয়া সেই সব  দুধ বা দুধ জাতীয় পদার্থ একটি বাসনে সংগ্রহ করা হয় এবং ভক্তদের প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় কিন্তু যেসব  মন্দিরে প্রচুর পরিমাণে দুধ ঢালা হয় দেই সকল  অনেক জায়গায়  আজকাল ক্ষীর বা অন্যান্য মিষ্ট দ্রব্য তৈরি করে প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়  যেন  প্রসাদের অপচয় না হয়।

আরেকটি কারণ আছে শিবের মাথায় দুধ দই ঘি মধু ইত্যাদি ঢালার, শুধু শিব নয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেসকল মন্দির আছে তার অধিকাংশতেই পাথরের প্রতিমা বিদ্যমান, এবারে খোঁজ নিয়ে দেখুন সেই সকল প্রতিমা অভিষেক-শৃঙ্গারের সময় এই সকল পদার্থ ছাড়াও আরো অনেক কিছু দিয়ে স্নান করানো হয়। এর পিছনে কিন্তু আছে এক বৈজ্ঞানিক যুক্তি। বৈজ্ঞানিকদের মতে এই সকল প্রক্রিয়ার কারণেই সেই সকল প্রতিমা ও শিবলিঙ্গ হাজার হাজার বছর পরও আজ বিদ্যমান আছে। আবহবিকার বা weathering of rocks সম্বন্ধে আপনারা সকলেই জানেন, এই দুধ,দই,ঘি মধু  আবহবিকার থেকে প্রতিমা ও শিবলিঙ্গ গুলিকে আজ অবদি রক্ষা করে আসছে, এ দেবাশীষ চক্রবর্ত্তীর মত নয় বৈজ্ঞানিকদের ধারণা। খোঁজ নিয়ে দেখুন সেই একই সময়ের তৈরি করা যে সকল মুর্ত্তি অলংকরণের জন্যে নির্মাণ করা হয়ে ছিল বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে বা অন্যান্য রাজপ্রাসাদে, আজ সেই গুলি ভঙ্গুর বা ধ্বংশপ্রাপ্ত অবস্থায় আছে।

 আমাদের স্বভাব আমরা আমাদের সনাতন শাস্ত্রের  সকল কিছু ভালোভাবে না জেনেই হই-হুল্লোড় শুরু করে দেই ,অথচ নিজেরা একটু চিন্তা করলেই এর সমাধানে আসা যায়। বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্ম ব্যবস্থায় প্রাচীন ঋষি মুনিরা এমন কিছু করে যান নি যা অবাস্তব। সেই সব ব্যাক্তিগন আমাদের চাইতে কিছু অংশে কম জ্ঞানী যে ছিলেন না তার বিস্তর প্রমাণ আছে এমনকি পাশ্চাত্য ও সে বিষয়ে একমত। আয়ুর্বেদের অধিকাংশ বিষয় আজকাল বিদেশী চিকিৎসকেরা অনুসরণ করছেন, দুর্ভাগ্যের কথা সেই সব প্রাচীন বিদ্যা আমাদের কাছে অবহেলিত তাই তো আমাদের এই অবস্থা। যে যা বলে তার বিচার না করে আমরাও সেই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে চলি। 

যে বিষয় আমাকে সবচাইতে ব্যাথিত করে সে হল যে কেন  সনাতন ধর্মকেই বারংবার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তার আচার অনুষ্ঠানের যথার্ততা প্রমাণ করতে? বিশ্বের এই প্রাচীনতম ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি করনীয় অনুষ্ঠানের পিছনে প্রশ্ন করলে তার যথাযত উত্তর পাওয়া যাবে। আর যেসকল বিষয়ে তার সঠিক উত্তর নাই সে কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়, আর সেই সকল কুসংস্কার বিশ্বের  সকল প্রান্তে সকল ধর্মে আছে মিলিয়ে নিবেন।

সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত।।

ওম শান্তিঃ শান্তিঃ  শান্তিঃ হরি ওম তৎ সৎ শ্রী রামকৃষ্ণায়  অর্পণমস্তু

 

 

 

 

 

 

নাগচন্দ্রেশ্বর মন্দির, উজ্জয়িনীর পুণ্যকথা ।।

                                                                                              --শ্রীদেবাশীষ চক্রবর্ত্তী ...



আপনারা জানেন কি? উজ্জয়িনীর নাগচন্দ্রেশ্বর মন্দিরের দরজা বৎসরে কেবল মাত্র ২৪ ঘন্টার জন্যে খোলা হয়!!!

त्वत्तो जगद्भवति देव भव स्मरारे, त्वय्येव तिष्ठति जगन्मृड विश्वनाथ।

त्वय्येव गच्छति लयं जगदेतदीश, लिंगात्मकं हर चराचरविश्वरूपिन्।


আপনারা জানেন কি? উজ্জয়িনীর নাগচন্দ্রেশ্বর মন্দিরের দরজা বৎসরে কেবল মাত্র ২৪ ঘন্টার জন্যে খোলা হয়!!! হ্যা সত্য! উজ্জয়িনীতে বিখ্যাত মহাকাল মন্দিরের তৃতীয় তলায় স্থিত নাগচন্দ্রেশ্বরের মন্দির শ্রাবণের শুক্লা পঞ্চমী যা নাগ পঞ্চমী বলে সেদিন কেবল মাত্র খোলা হয়। কথিত যে এই মন্দিরে স্বয়ং সর্পরাজ তক্ষক বাস করেন। জানা যায় আনুমানিক ১০৫০ইংরেজীতে রাজা ভোজ এই মন্দির তৈরী করেন এবং এই মন্দিরের প্রতিমা সুদূর নেপাল থেকে আনা হয় বলে শুনা যায় এরপর ১৭৩২ সালে মহারাজ রাণোজী সিন্ধিয়া এই মন্দিরের পুণঃ সংস্করণ করেন। সাধারণতঃ নাগশয্যায় লক্ষ্মী নারায়ণ কে বিরাজিত দেখা যায় কিন্তু এখানে শিবও পার্বতীকে নাগ শয্যায় বিরাজিত ভাবে দেখা যায়। উজ্জয়িনী ছাড়া বিশ্বে অন্য কোথাও এমন প্রতিমা দেখা যায় না। এখানে শিব, পার্বতীর প্রতিমা ছাড়াও গণেশ ও দশ মুখ বিশিষ্ট নাগের প্রতিমাও দেখা যায়। এখানে শিবের গলায় ও হাতে সাপ পেঁচানো দেখা যায়।


পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সর্পরাজ তক্ষক শিবকে তুষ্ট করার জন্যে কঠোর তপস্যা শুরু করেন, তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ঠ হয়ে দেবাদিদেব মহাদেব তক্ষকরাজকে অমরত্ব বরদান করেন। শিবের বর পেয়ে তক্ষক রাজ এই বনেই শিবের সান্নিধ্যে বাস করতে থাকেন কিন্তু তাঁর আশঙ্খা ছিল যে এখানে থাকলে তাঁর একান্ত সাধনায় না বিঘ্ন ঘটে তাই এই মন্দির শুধু একদিনই খোলা হয়, আর সেইদিন লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় এই মন্দির দর্শনের জন্যে। কথিত এই মন্দির একবার দর্শন করলে সেই ভক্তের সর্পভয় দূর হয় আর সর্পাঘাতে মৃত্যু ও হয় না।
জয় জয় মহাদেব

চিত্র সৌজন্যে গুগল চিত্র

Friday, 23 June 2023

কামাখ্যা মন্দিরের ইতিহাস

 

           




  নবম শতাব্দীতে উল্লেখিত বাণমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যা মন্দিরের শিলালিপি-উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শিলালিপি থেকে জানা যায় যে  খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম  শতাব্দীতে এখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল।
কথিত  সুলেমান কিরানির সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দিরটি তখন  ধ্বংস করেছিলেন। আবার  ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে  আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতা রাজ্য  


আক্রমণের সময়
এই মন্দির ধ্বংস করেন। কথিত আছে, কোচ  তথা কামতাপুর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ এই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন এবং  তিনিই এই মন্দিরে পূজা পুনরায় আরম্ভ করেন। তবে তাঁর পুত্র নরনারায়ণের  রাজত্বকালে আনুমানিক ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নরনারায়ণ ও তাঁর ভাই চিলারায় এই মন্দির নির্মাণের কাজ শেষ করেন। জানা যায় এই মন্দির    পুনর্নির্মাণের সময় পুরনো মন্দিরের উপাদান গুলি আবার ব্যবহৃত করা হয়েছিল। এরপর অহোম রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড়ো করে তোলেন।

কোচবিহারের মহারাজা এবং তার ভ্রাতা চিলারায়  ছিলেন মা কামাখ্যার বিশেষ ভক্ত। কথিত আছে, সন্ধ্যা আরতির সময় বাজনা শুরু হলে কামাখ্যা দেবী স্বয়ং আবির্ভূত হতেন এবং বাজনার তালে তালে নৃত্য করতেন। কৌতুহল বশতঃ মহারাজ নরনারায়ণ একদিন পূজারী ব্রাহ্মণ কেন্দুকলাই এর সাহায্যে নৃত্যরতা দেবীকে গোপনে দর্শন করেন। এর ফলে মা কামাখ্যা দেবী  ক্রোধান্বিত হয়ে রাজাকে অভিশাপ দেন যে, রাজ পরিবারের কেউ এর পর থেকে কামাখ্যা মন্দির দর্শন  করতে পারবেন না এবং কোচ-রাজবংশের যিনি কামাখ্যা মন্দির দর্শন  করবেন তিনি বা তাঁর পরিবার তৎক্ষণাৎ  মৃত্যুমুখে পতিত হবেন।

রাজা নরনারায়ণ দেবীর নৃত্য  দর্শনের সময়েই পূজারী ব্রাহ্মণ কেন্দুকলাই এর মৃত্যু হয়।আজ ও সেই পুজারী ব্রাহ্মণ কেন্দু কলাইয়ের প্রস্তুরীকৃত দেহ মন্দির চত্বরে আছে। অভিশাপগ্রস্থ মহারাজা নরনারায়ণ, তাঁর অপরাধেই  তাঁর বংশধরগণ মূর্তি দর্শন পূজা দিতে পারবেন  না এই ভেবে  অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করেন তাঁর আকুল প্রার্থনায়  মা সদয় হয়ে বলেন তিনি বাণেশ্বর শিব মন্দিরের নিকট সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দেবী বিগ্রহে আর তারপাশে কামরাঙ্গা বৃক্ষে দেবীরূপে সর্বদা অবস্থান করবেন। তাঁর বংশধরেরা সেখানে পূজা দিলে দর্শন করলে মা কামাখ্যার পুজা দর্শন এর ফল লাভ হবে। মহারাজা নরনারায়ণের পরবর্তী সময়ে কোনো মহারাজা বা তাঁর বংশধরেরা আজও  কামাখ্যা মন্দির দর্শন  করেননি

Saturday, 11 March 2023

হনুমান ও শনিদেবের সম্পর্ক

 হনুমান ও শনিদেবের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত।



সূর্য সংহিতা অনুসারে হনুমান শনিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি শিবের রুদ্র রূপ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে হনুমানের ত্বকের রঙ প্রায়শই ভগবান শনিদেবের সঙ্গে তুলনা করা হয়৷ কিংবদন্তি অনুসারে, ভগবান হনুমান শনিদেবকে রাবনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন কথিত আছে যে লঙ্কার রাজা রাবণ, ছেলে মেঘনাদের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে সব গ্রহদের বন্দী করেছিলেন। তার মধ্যে শনিদেবও ছিলেন। শিবভক্ত রাবণ শিবের শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। সেই বিশেষ শক্তিবলেই তিনি বন্দী করেছিলেন গ্রহদের। রাবণের মৃত্যুবাণ খুঁজতে খুঁজতে হনুমান আবার পৌঁছে যান তাঁর কারাগারে।সেখানে তিনি সব গ্রহকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পান এবং হনুমান তাঁদের মুক্ত করেন। তখন সব গ্রহরাই হনুমানকে আশীর্বাদ করেন। সেই আশীর্বাদে তাঁরা জানান, হনুমান এবং তাঁর ভক্তদের ওপর কখনও গ্রহদের কুপ্রভাব পড়বে না। পড়লেও ধীরে ধীরে কেটে যাবে।এবং বন্দী দশা থেকে মুক্তির বিনিময়ে, শনি তাঁর কাছে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, যে কেউ শনিবারে হনুমানের পূজা করবে তাকে সব কিছুতেই অব্যাহতি দেওয়া হবে।
অপর এক কাহিনীতে পাওয়া যায়......
বর্তমানে কলিকাল চলছে আর এই কলি কালে শনির প্রভাব সবচেয়ে বেশি বলে কথিত।  আমরা সকলেই জানি যে  হনুমান অমর, তিনি রামভক্ত।  কলিকালেও  একবার হনুমান একমনে  রাম নাম জপ করছিলেন তখন  সেই স্থান দিয়ে শনিদেব যাচ্ছিলেন। কিন্তু, হনুমানের রাম নাম জপের প্রভাবে সেই স্থানে এক বলয় তৈরি  হয় যা শনিদেব অতিক্রম করতে পারছিলেন না। এতে শনি্দেব  যাবতীয় অতীত ভুলে প্রথমে হনুমানকে কটূক্তি করতে শুরু করেন। এরপর হনুমানের  ধ্যান ভাঙাতে হনুমানের হাত ধরে টানাটানি শুরু করেন। এতে হনুমানের শরীরে ছ্যাঁকা অনুভব হয় এবং তাঁর ধ্যান ভেঙে যায়। তিনি শনিদেবকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন।শনিদেব তখন  হনুমানকেকে পর্যুদস্ত করতে কুদৃষ্টির প্রয়োগ করেন। কিন্তু, তাতে  হনুমানের কিছুই হয় না। এরপর শনিদেব দিব্যাস্ত্র দিয়ে ভনুমানকে আঘাত করার চেষ্টা করেন। এতে হনুমান পালটা  ল্যাজে বেঁধে শনিদেবকে গাছ এবং পাথরের ওপর বারবার আছাড় মারেন।শনিদেব  তখন জানান, যে কলিযুগে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠএবং তাই সেখানে  হনুমানের  কোনও জোর খাটবে না। উলটে তিনি হনুমানের ওপর ভর করবেন। এই বলে শনিদেব  হনুমানের উপর  ভর করেনকিন্তু এতে বহনুমানের  মাথায় চুলকোনির মত অনুভূত হয় মাত্র তখন তিনি একটা  বিরাট আকারের পাথর তুলে  নিজের মাথা ঘষতে শুরু করেন, যাতে শনিদেবের শরীরে আঘাত লাগে। পাথরের ঘষায় শনিদেব  বজরংবলীর মাথা থেকে নেমে যানএবং তাঁর ওপর আর আঘাত না-করার জন্য ঙ্ঘনুমানের  কাছে অনুরোধ করেন। একইসঙ্গে শনিদেব জানিয়ে দেন যে  ভনুমান ও তাঁর ভক্তদের ওপর কখনও শনিদেবের প্রভাব খাটবে না। খাটলেও ধীরে ধীরে তা কমে যাবে আর একইসঙ্গে শনিদেব জানিয়ে দেন, তিনি ভনুমানের  সঙ্গেই থাকবেন।  সেই কারণে, ভারতর্বষে বহু মন্দির রয়েছে, যেখানে ভনুমানের সাথে শনিদেবেরও পুজো হয়।
আরেকটি কাহিনী অনুসারে...

হনুমান  হলেন  গিয়ে সূর্যেদেবের শিষ্য। আর, শনিদেব হলেন সূর্যদেব এবং সূর্যদেবের পত্নী দেবী ছায়ার ছেলে। নানা কারণে শনিদেবের সাথে সূর্যদেবের সম্পর্ক খারাপ হয়।  শনিদেব কুদর্শন হওয়ায় সূর্যদেব নিজের ছেলেকে দেখতে পারতেন না। পরে অবশ্য নিজের  ভুল বুঝতে পেরে শনিদেবকে  বারবার ডেকে পাঠান সূর্যদেব। কিন্তু, শনিদেব অভিমান বশতঃ আসতে রাজি হননি।শেষে শিষ্য বহনুমানকে দায়িত্ব দেন সূর্যদেব শনিদেবকে নিয়ে আসার জন্যে। শনিসেবের  প্রখর তেজের বলয় উপেক্ষা করে হনুমান শনিলোকে প্রবেশ করেন এবং  তিনি শনিদেবকে তাঁর সঙ্গে সূর্যালোকে যাওয়ার জন্যে আহ্বান জানান। এতে  শনিদেব সেই প্রস্তাব   হেসেই উড়িয়ে দেন । উপরন্তু এক বানর বিনা অনুমতিতে তাঁর লোকে প্রবেশ করেছে, এবং তাঁকে নিজের সাথে যেতে বলছে, এসব দেখে-শনিদেব কুপিত হন। কথিত আছে, এরপর শনি্দেব সরাসরি আক্রমণ করেন হনুমানকে। কিন্তু, সুবিধা করে উঠতে পারেননি। উলটে, ভনুমানই তাঁকে বেশ কয়েকবার আছাড় মেরে তুলে নিয়ে যান সূর্যালোকে।


Monday, 6 March 2023

হোলিকা দহন

 

হোলি উৎসবের নেপথ্যে রয়েছে শ্রীমদ্ভাগবতের এক কাহিনী

হিরণ্যকশিপুর বোন ছিলেন হোলিকা, কঠোর তপস্যার ফলে ব্রহ্মার থেকে এক বর লাভ করেছিল যে আগুন এ তার শরীর পুড়বে না, যদি না তিনি এই ক্ষমতার অপব্যাবহার করেন। এদিকে হিরণ্যকশিপু তার পুত্রের হরি ভক্তি তে রুষ্ট হয়ে তাকে অনেক বার মারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন । তখন হোলিকা প্রহ্লাদ কে হত্যা করার জন্য হিরণ্যকশিপুর সাথে মিলে এক ষড়যন্ত্র করেন । ঠিক হয় হোলিকা প্রহ্লাদ কে কোলে নিয়ে জলন্ত চিতায় বসবেন । এতে প্রহ্লাদ পুড়ে মরবে । আর ব্রহ্মার বর থাকার জন্য হোলিকার কোন ক্ষতি হবে না । সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী হোলিকা প্রহ্লাদ কে কোলে নিয়ে চিতায় বসলেন । চিতায় আগুন লাগানো হল । প্রহ্লাদ তার পিসির কোলে বসে ভগবান বিষ্ণুর নাম জপতে থাকলেন ।দেখতে দেখতে পাহাড় সম আগুনের শিখা উঠলো । কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় ভক্ত প্রহ্লাদ এর তো কিছুই হল না, কিন্তু ব্রহ্মার সতর্কতা ভুলে ব্রহ্মা প্রদত্ত বরদানের অসৎ ব্যাবহার করার ফলে সেই বর নিষ্ফল হলো আর হোলিকা পুড়ে ছাই হলো । সেদিন ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমা, তাই এই দিন টি বসন্ত উৎসব নামে পালিত হয়ে আসছে । এই দিন টি হল অধর্মের ওপর ধর্মের বিজয় এর দিন ।পাপের ওপর পুন্যের বিজয়ের দিন ,আসুরিক শক্তির ওপর দৈবিক শক্তির বিজয়ের দিন ।হোলিকা ছিল দূরাচারী রাক্ষসী তাই তার মৃত্যুতে যে উত্‍সব পালন করা হয় তাকে হোলি উত্‍সব বলে। হোলির পূর্ব রাতে যেই আগুনের ঝোপ বানানো হয় তা আসলে হোলিকারই চিতা।

Saturday, 14 January 2023

মকর সংক্রান্তির ইতিকথা ও ইতিহাস

 




মকর সংক্রান্তির ইতিকথা ও ইতিহাস

পৌষ বা মকর সংক্রান্তিতে সূর্য ধনু রাশি থেকে মকরে সঞ্চারিত হয়, তাই এর নাম 'মকর সংক্রান্তি'। একে 'উত্তরায়ণ সংক্রান্তি'-ও বলে, কারণ এই দিন থেকে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে। পৌরণিক মতে উত্তরায়নের সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদের দিন শুরু হয়। আর দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদের রাত্রি শুরু হয়। আর সেই দীর্ঘ রাত্রি কাটিয়ে দেবতারা দিনে প্রবেশ করার সময়টিকে হিন্দু শাস্ত্র মতে ধুমধাম সহকারে পালন করা হয়।এই সংক্রান্তির ব্রহ্মমুহূর্তে যমুনা নদীতে মকর-স্নান করলে আয়ুবৃদ্ধি হবে -- এই বিশ্বাসে মাতা যশোমতী বালক কৃষ্ণকে স্নান করাতে নিয়ে যান। পরে এদিনেই যমুনায় স্নান সেরে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধিকার সঙ্গে 'মকর-পাতায়', এ হল আত্মার সঙ্গে আত্মার দৃঢ় বন্ধন স্থাপন।
বাংলার অনেক স্থানে একসময় কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে কনকনে ঠান্ডার ভোরে একমাস ব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করতো। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা-তামসিকতার রিপুগুলিকে জয় করার এ ছিল এক সংগ্রামী মনোবৃত্তি। ছড়া গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম ছিল: "এক ডুবিতে আই-ঢাই।/দুই ডুবিতে তারা পাই।।/তিন ডুবিতে মকরের স্নান।/চার ডুবিতে সূর্যের স্নান।/পাঁচ ডুবিতে গঙ্গাস্নান।।"
২. উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে বাস্তুপূজার প্রচলন আছে। শঙ্খপাল, বঙ্কপাল, ক্ষেত্রপাল, নাগপালের ধ্যান করে বাস্তুর ধ্যান ও মানসোপচারে পূজা করা হয় এইদিন। বাস্তুর প্রণাম মন্ত্র হল, "ওঁ বাস্তুরাজ নমস্তুভ্যং পরমস্থানদায়ক। সর্বভূতজিতস্ত্বঞ্চ বাস্তুরাজ নমোহস্তু তে।" এরপর পাদ্যাদি দিয়ে গ্রাম্যদেবতার পূজা করা হয় এবং পায়স-বলি দান করা হয়।
'আমার মা'র বাপের বাড়ি' গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন, পৌষ সংক্রান্তি "মহাধুমধামের সংক্রান্তি। বসতভিটার মঙ্গলের জন্য বাস্তুপূজা হয় এ দিন। তুলসীমন্ডপে 'ঝিকা' গাছের ডাল কেটে তার তলায় পুজো হয়। পুরুতমশাই নিজে 'চরু' রান্না করে দিয়ে যান। আজ এই চরু-ই পূজার প্রধান অঙ্গ।" চরু রান্না হয় পাটশলমির আগুনে, নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে।
৩. পৌষ সংক্রান্তি দিনে গ্রাম-বাংলার অনেক স্থানে উঠোনে মড়াই-এর পাশে 'উঠোন লক্ষ্মী'র পুজো হয়। তিনিই কোথাও 'পৌষলক্ষ্মী'। এদিন বাড়ির উঠোন গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে, শুচি-স্নিগ্ধ করে তোলা হয়। ধানকাটা পর্বে যে 'পৌষ তোলা'র চার-পাঁচ গুচ্ছ ধানগাছ সাদরে গৃহস্থ বাড়িতে আনা হয়েছিল, তাই গাদা থেকে নামিয়ে মাথায় বহন করে নামানো হয় উঠোনে। গোটা উঠোন জুড়েই আলপনার নান্দনিকতা। আঁকা হয় লক্ষ্মীর নানান গয়না; চাষের সমস্ত উপকরণ--গরু, লাঙল, জোয়াল, মই; আর লক্ষ্মীর পা--পৌষ গাদা থেকে পুজোস্থল পর্যন্ত, পুজোস্থল থেকে গৃহের সিংহাসন পর্যন্ত। এই চরণ চিহ্নে পা ফেলেই যেন লক্ষ্মী ঘরে আসবেন। বাংলার কোনো কোনো স্থানে একে বার (বাহির) লক্ষ্মীপুজোও বলে। পুজো শেষ হলেই ঠাকুর তোলা যায় না। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা বা শেয়ালের (দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে শেয়াল লক্ষ্মীর বাহন বলে কথিত) ডাক শুনে উঠোন থেকে লক্ষ্মীকে ঘরে তোলা হয়। গভীর রাতে লক্ষ্মী তুলে উঠোন নিকিয়ে ঘুমতো যান গৃহকর্ত্রী।
৪. পৌষ সংক্রান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি লোকাচার হল 'আওনি-বাউনি' বা 'আউরি-বাউরি'। এটি আগের দিন পালিত হয়। তবে দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে এর নাম 'চাঁউনি-বাউনি' বা 'চাউড়ি-বাউরি' যা পৌষপার্বণের দু'দিন আগে 'মচ্ছিমূলো' খেয়ে পালিত হয়। 'গণদেবতা' উপন্যাসে এর বর্ণনা এইরকম, "....আউরি-বাউরি দিয়া সব বাঁধিতে হইবে, মুঠ লক্ষ্মীর ধানের খড়ের দড়িতে সমস্ত সামগ্রীতে বন্ধন দিতে হইবে, -- আজিকার ধন থাক, কালিকার ধন আসুক, পুরানে নূতনে সঞ্চয় বাড়ুক। লক্ষ্মীর প্রসাদে পুরাতন অন্নে নূতন বস্ত্রে জীবন কাটিয়া যাক নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায়। অচলা হইয়া থাক্ মা, অচলা হইয়া থাক্।" সোনার পৌষ যে চলে যায়, তাকে বাঁধতে হবে! তাই শিসসহ ধানগাছ পুজো করে ঘরের খুঁটি, গোলা, গোয়াল ঘর, সিন্দুক ঢেঁকিশালে তা বাঁধা হয়। আর শস্য-সম্পদের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করা হয়। তারই অঙ্গ হিসাবে বাংলার মেয়েরা ছড়া কেটে পৌষ বন্দনা করেন, "পৌষ পৌষ -- সোনার পৌষ/এস পৌষ যেয়ো না/জন্ম জন্ম ছেড়োনা।/না যেয়ো ছাড়িয়ে পৌষ--/না যেয়ো ছাড়িয়ে,/পৌষ পৌষ -- সোনার পৌষ।"
৫. পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে রাঢ় তথা পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় 'টুসু জাগরণ' হয়। টুসু উত্সবের শুরু অঘ্রাণ সংক্রান্তিতে। পৌষ সংক্রান্তির ভোরে সূর্যোদয়ের আগে টুসু বিসর্জন দেওয়া হয়। কারণ সূর্যের সঙ্গে টুসুর ভাসুর-বুয়াসি বা ভাদ্র-বউ সম্পর্ক। যেহেতু চৌডল ব্যবহার করলে সূর্যদেব দর্শিত হন না, তাই সুদৃশ্য চৌডলে টুসু ভাসান যায়।
তুষ-তুষলীর ব্রতিনীরা এই দিন মাস-কালীন ব্রতের শেষে জমিয়ে রাখা তুষ-গোবরের গুলি মাটির হাঁড়িতে রেখে আগুন ধরায়। তারপর তা ভাসিয়ে দেয় নদী বা পুকুরের জলে। একাধিক ব্রতিনীর ভাসানো অগ্নিশিখা বহনকারী হাঁড়ি বায়ুচালিত হয়ে ঘাট-ঘাটলার কিনারে কিনারে চরে বেড়ায়।
৬. বাংলার কোনো কোনো স্থানে এদিন 'ধর্মের পিঠে' উত্যাপিত হয়। এই লোকানুষ্ঠানটি ধর্ম বা সূর্য পূজার অঙ্গ। বাড়ির উঠোন সকালে গোবর জলে নিকিয়ে নতুন কলকে নিয়ে পিটুলির ৫টি গোলাকার ছাপ দেওয়া হয়। ছাপ পড়ে গোয়ালে, গবাদিপশুর দেহে, গোলায়, ঢেঁকিশালে এবং ঘরের মধ্যে। গৃহস্থের সামগ্রিক কল্যাণ কামনাই এই লোকানুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য।
৭. দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় এদিন বত্সরান্তের কৃষিকাজ সমাপনান্তে খামার খুঁটিকে কেন্দ্র করে উত্সবের আয়োজন হয়। একে 'মেহি পূজা' বলে, কারণ 'মেহি'-র অর্থ খুঁটি। এই খুঁটি ঝাড়াই-মাড়াই সহ নানান কাজের সাক্ষী, গরু বাঁধার স্থান। তাই মেহি পূজা বা খামার পূজা হল এক কৃতজ্ঞতার অনুষ্ঠান, ধন্যবাদাত্মক চিন্তন। খুঁটিকে কেন্দ্র করে আঁকা হয় নানান কৃষি উপকরণের আলপনা, পরিষ্কার করে সাজানো হয় সেইসব উপকরণ। কৃষক-পুরুষ শেয়ালের ডাক শুনে পুজোয় বসেন। পুজো শেষে নতুন ধানে ভরা মান মরাইতে তুলে সে বত্সরের মত কৃষিকার্যের সমাপ্তি হয়।
৮. পৌষ সংক্রান্তিতে গ্রহণ করা হয় দধি সংক্রান্তির ব্রত। এ দিন সেই ব্রতের সূচনা, প্রতি সংক্রান্তিতে তার আচরণ এবং পরের বছর এই দিনেই ব্রতের প্রতিষ্ঠা বা সমাপ্তি। এই দিন দধি দ্বারা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে স্নান করিয়ে দধি ও ভোজ্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়। শোনা হয় ব্রতকথা।
ফল-সংক্রান্তি ব্রতের অঙ্গ হিসাবে এই সংক্রান্তিতে হরিতকী দান করলে হংসযুক্ত রথে আরোহণ করে বৈকুন্ঠে গমন করা যায় বলে হিন্দুদের বিশ্বাস।
৯. পৌষপার্বণ পিঠেপুলির অনুষ্ঠান। এজন্য চাল কোটা হয় 'বাউড়ি'-র আগের দিন। চাল গুঁড়ো, ভেজা চাল সর্বদা উঠোন-ঘর করতে হলে তা পাত্রে ঢেকে, তুলসি পাতা আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে নিয়ে যেতে হয়, নইলে তা ভূতে পায়।
ঠাকুরমা'র ঝুলির 'কাঁকণমালা, কাঞ্চনমালা' গল্পে রয়েছে 'পিট-কুড়ুলির ব্রত'-র কথা, রাজ্যে পিঠা বিলানোর অনুষ্ঠান। রাণীকে চালের গুড়োয় আঙ্গিনায় আলপনা দিয়ে পিড়ি সাজিয়ে দিতে হয়, দাসীরা পিঠের যোগার-যাগাড় করে। রাণী রূপী দাসী তৈরি করেন আস্কে পিঠা, চাস্কে পিঠা আর ঘাস্কে পিঠা; দাসী বানান চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশী, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা। দাসী চালের গুঁড়োয় খানিকটা জল মিশিয়ে এতটুকু নেকড়া ভিজিয়ে পদ্ম আঁকলেন, পদ্ম-লতার পাশে সোণার সাত কলস আঁকলেন; কলসের উপর চূড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া, ময়ূর, পুতুল, মা লক্ষ্মীর সোনা পায়ের দাগ।
সংক্রান্তির পূর্বদিন অনেক স্থানে ভাজা পিঠে হয়; তা সেদিন ও পরদিন সকালে খাওয়া হয়। সংক্রান্তির দিন তৈরি হয় নানান পিঠে, সেগুলি সেদিন ও পরদিন খাওয়া হয়। পৌষ পার্বণের পরদিনও পিঠে তৈরি হয় যা তার পর দিন পর্যন্ত খাওয়া হয়। এইভাবে গ্রাম বাংলায় পরপর চারদিন পিঠে উত্সব ও ভোজন।
পৌষ সংক্রান্তিকে 'তিল সংক্রান্তি'-ও বলে। এদিন তিল দিয়ে নাড়ু, মিষ্টি তৈরি করে পূজায় নিবেদিত হয়। লোকবিশ্বাস, এই দিন তিল না খেলে নাকি দিন বাড়ে না অর্থাত্ সূর্যের মকর যাত্রা সংঘটিত হয় না।
১০. মেদিনীপুরে এইদিন লৌকিকদেবী বড়াম; মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলীতে সিনিদেবী এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বারা ঠাকুরের যুগ্মমূর্তি, নারায়ণী ও দক্ষিণ রায়ের বাত্সরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
মেদিনীপুর, পিংলা, ময়না, সবং অঞ্চলের মাহিষ্য কৃষক সম্প্রদায় এদিন বিকেলে 'বণিপুজো'র আয়োজন করে। গৃহের পুরুষ বা নারীরাই এর উদ্যোক্তা এবং পূজক। এর তিনটি পর্যায় -- মই খুঁটি প্রতিষ্ঠা, খেত মাড়ান এবং 'সাঁথ ধরা'। এটি মেহি পূজার মতই এক লোকাচার। খেত মাড়ান পর্বে চাষের জমিতে রক্ষিত একগুচ্ছ ধান গাছের ('ঝুঁটি') গোড়ায় 'লবাত্' (নতুন ধানের চাল বেটে প্রস্তুত মিষ্টান্ন) ও ফলমূল নৈবেদ্য রেখে সরষে ও সাদা কল্কে ফুল ('শুক্ল যাদু'-র প্রতীক) দিয়ে পুজো করতে হয়। এরপর সেই ঝুঁটি ছিঁড়ে তা মইখুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়। আগামী বছর ভালো ধান হবার এ এক লৌকিক প্রার্থনা। 'সাঁথ ধরা' হল বন্য প্রাণির ডাক শুনে সেই পূজিত 'ঝুটি' সযত্নে ধানের গোলায় তুলে রাখার অনুষ্ঠান। লোকবিশ্বাস, শেয়ালের সাঁথ ধরা সবচাইতে সৌভাগ্যের বিষয়।
রাঢ় অঞ্চলের অনেক স্থানে পৌষ সংক্রান্তির পরদিন তপশিলী সম্প্রদায়ের মানুষ কর্তৃক 'আক্ষেন' বা 'আখ্যান দিন' পালিত হয়। একে 'এখ্যান যাত্রা'-ও বলে। এদিন লোকদেবতা ও অপদেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়। পূজার শেষে আয়োজিত হয় নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান।
অনেক স্থানে এইদিন গ্রামের বালকেরা 'কুলাইর মাগন' বা 'কুলের মাগন' বা 'পৌষ মাগন' পালন করে। তারা আমন ধান উঠে যাবার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে চাল, ডাল, সবজি মাগন করে আনে তা এইদিন নিজেরাই মাঠে রান্না করে কুলাই ঠাকুরকে নিবেদন করে এবং একত্রে ভোজন করে।
১১. একটি প্রচল কথা হল, "অন্নচিন্তা চমত্কারা"। কৃষকের গোলায় যখন ক্ষুধান্নের মজুত পরিপুষ্টি লাভ করে তখনই আসে শান্তি ও সমৃদ্ধির উত্সব। ফসলোত্তর এই সংক্রান্তি সেই শান্তির বার্তাই নিয়ে আসে সমগ্র ভারতীয় উপ-মহাদেশে। পশ্চিম ভারতে এটি 'মকর সংক্রান্তি', দক্ষিণের রাজ্যে 'পোঙ্গাল', উত্তর ভারতে 'লোহরি', অসমে 'ভোগালি বিহু'; সুনির্দিষ্টভাবে কর্ণাটকে 'ইল্লুবিল্লা' এবং 'মকর সংক্রমণা', উত্তর প্রদেশে 'খিচড়ি', গুজরাটে 'উত্তরায়ণ', হরিয়াণা, হিমাচল প্রদেশে 'মাঘী', মহারাষ্ট্রে 'তিলগুল', বিহার-ঝাড়খন্ডে 'সকরাত'। সর্বত্রই ফসল তোলা, ঝাড়াই, মাড়াই-এর অবসরে নদী বা সাগরে পুণ্যস্নান; ঐতিহ্যবাহী খাদ্যসামগ্রী রচনা ও বিতরণ; নববস্ত্র পরিধান আর সূর্যদেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উত্সব।
প্রয়াগ, হরিদ্বার, গড় মুক্তেশ্বর, গঙ্গাসাগর প্রভৃতি স্থানে এই উপলক্ষে জমকালো মেলা বসে। প্রয়াগে কুম্ভ মেলার সূচনা আর শবরীমালায় তীর্থযাত্রার সমাপ্তি। লোকবিশ্বাস, এদিন পরলোকগমন করলে তাকে আর ইহজীবনে ফিরে আসতে হয় না, সরাসরি বৈকুণ্ঠ লাভ হয়।
নানান রাজ্যে 'তিল-গুড়' বা 'তিল-লাড্ডু' এদিনের শীতলতায় এক শক্তিদায়ী উষ্ণ খাবার। দক্ষিণের রাজ্যে তৈরি হয় 'পোঙ্গাল'। তামিল বা তেলেগু ভাষায় শব্দটির অর্থ হল 'হাঁড়িতে ভাত সেদ্ধ করা'। নতুন চাল, ভাজা মুগ, বাদামি আখের গুড়, ইক্ষু-শক্কর, দুধ ও নারকেল দুধের সঙ্গে কিশমিশ, কাজু, এলাচে প্রস্তুত এক সুস্বাদু মিষ্টান্ন।
গুজরাটে এদিন পালিত হয় ঘুড়ি উত্সব। এর প্রতীকি তাত্পর্য অসীম। আপন আকুতি দেবতার কাছে নিবেদনের নান্দনিকতায় রং-বেরঙের ঘুড়ির রূপ ধারন করে তারা আকাশে ওড়ে। তেলেগু গৃহস্থেরা এদিন গৃহের পুরাতন সামগ্রী বিক্রি করে বা আগুন ধরিয়ে 'বন-ফায়ার' করে। পাঞ্জাবীদের মধ্যেও এই প্রথা প্রচলিত আছে। অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানায় গবাদিপশুকে এদিন নানান সামগ্রী ভোজন করানো হয়। গুজরাটে তাদের গায়ে আঁকা হয় নানান রং। এই দিনে জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে স্মরণ-মনন করে মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দেন গুজরাটি পন্ডিতেরা। অধ্যাত্মিক মনন ও অভ্যাসে এই দিনটি তাই মান্যতা পেয়ে এক সর্ব ভারতীয় উত্সবের মর্যাদা লাভ করেছে; পাপ, অপরিচ্ছন্নতা ও অপবিত্রতা দূরীকরণই যার মূল সুর।
সংগৃহীত

Friday, 16 December 2022

বিশালাক্ষী দেবী

 

প্রসঙ্গঃ-বিশালাক্ষী দেবী
বিশালাক্ষী দেবী মহামায়া সতীর অপর এক রূপ। গ্রাম বাংলায়ও বিশালাক্ষী দেবীর বহুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক অঞ্চলে এই বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির রয়েছে।বিশালাক্ষী দেবীর প্রধান মন্দির ভারতের বারাণসী শহরের বিশ্বনাথ মন্দিরের পশ্চাদে মীরঘাটে অবস্থিত। পুরাণ মতে, ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম হল এই বারাণসীর বিশালাক্ষী দেবীর মন্দির।
বাংলার কৃষিজীবী, জলজীবী ও বনজীবী লোকসমাজ তথা সুন্দরবন এলাকাকে বিশালাক্ষী দেবীর অনেক মহিমা রয়েছে। বিশেষত, কৃষক, জেলে, মৌয়ালি-বাওয়ালি পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এই দেবীর আরাধনা করেন। কথায় বলে, সুন্দরবনের জঙ্গলমহল যতদূর ছড়িয়ে রয়েছে, এই বিশালাক্ষী দেবীর পুজোর ক্ষেত্রে ততদূর ছড়িয়ে রয়েছে।
কথিত আছে যে, দেবাদিদেব শিব যখন দেবী সতীর দেহ কাঁধে করে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করছিলেন, তখন মহাদেবকে শান্ত করতে বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, সেই সময় নাকি দেবীর ছিন্ন ভিন্ন দেহের থেকে দেবীর কর্ণ ও কুণ্ডল এই অঞ্চলে পতিত হয়েছিল। তাই বিশালাক্ষী দেবী এখানে মণিকর্ণি নামে পরিচিত।অনেকে আবার মনে করেন এই কর্ণকুণ্ডল শুধুমাত্র অলংকার, এটি দেহের অংশ একেবারেই নয়। তাই এই মন্দিরকে উপপীঠ বলা যেতেও পারে।আবার অনেকের মতে, এই স্থানে দেবীর তিনটি নয়ন বা চোখের একটি পতিত হয়েছিল। মহামায়া দিব্যচক্ষু দিয়ে সমগ্র বিশ্ব দেখতে পান। তাই এখানে এই দেবী বিশালাক্ষী দেবী নামে পরিচিত।
বিশালাক্ষী মায়ের ধ্যান-
ধ্যায়েদ্দেবীং বিশালাক্ষীং তপ্তজাম্বুনদপ্রভাম্।
দ্বিভুজামম্বিকাং চণ্ডীং খড়গখেটকধারিণীম্।।
নানালংকারসুভগাং রক্তাম্বরধরাং শুভাম্।
সদা ষোড়শবর্ষীয়াং প্রসন্নাস্যাং ত্রিলোচনাম্ ।।
মুণ্ডমালাবলীরম্যাং পীনোন্নতপয়োধরাম্ ।
শবোপরি মহাদেবীং জটামুকুটমণ্ডিতাম্।।
শত্রুক্ষয়করাং দেবীং সাধকভীষ্টদায়িকাম্ ।
সর্বসৌভাগ্যজননীং মহাসম্পদপ্রদাং স্মরেৎ ।।
----তন্ত্রসার
অনুবাদ - মায়ের গাত্র বর্ণ তপ্তকাঞ্চনের মতো, দ্বিভুজায় তিনি খড়গ ও ঢাল ধারণ করে আছেন, মায়ের গাত্রদেশে নানা অলঙ্কার শোভা পাচ্ছে, পরিধানে রক্তবস্ত্র , তিনি সদা সর্বদাই ১৬ বছরের যুবতী থাকেন, তার অনন প্রসন্নতা যুক্ত, তার তিনটি চোখ, তার স্তনযুগল স্থূল ও উন্নত, তার গলায় মুণ্ডমালা সুশোভীত,তিনি শবরূপ শিবের উপর আসিনা, তার মস্তকে জটা ও কিরীট শোভা পাচ্ছে, ইনি সর্বদা সাধকের শত্রুনাশিনী তথা অভীষ্ট বর প্রদান কারিনী, তিনি সব প্রকারের সৌভাগ্যের অধিশ্বরী ও মহাসম্পদ প্রদান কারিনী।

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...