Friday, 15 September 2017

মানস পূজা

সকল প্রকার পুজার মধ্যে মানস পূজাকে শ্রেষ্ঠ পূজা বলে গণ্য করা হয়। মানস পুজায়,সাধারণত যে সকল উপাচারে পূজা করা হয়ে থাকে সেই সমস্ত উপচারই নিবেদন করা যায় তবে তা প্রতীকী অর্থে। কিভাবে সেই স্থুল জিনিষ গুলি নিবেদন করা হয় তার বর্ণনা মহানির্বাণতন্ত্রে পাওয়া যায়। সেখানে  মানস পুজো সম্বন্ধে এই শ্লোকটি আছে


পূজয়েৎ পরয় ভক্ত্যা মানসৈ রূপচক্রৈ হি।
হৃৎপদ্মম্ আসনম্ দদাৎ সহস্রাচ্যুতামৃতৈ হি।।
পাদ্যম্ চরণদ্বয়ো ধ্যায়াৎ মানসস্তবার্ঘ্যম্ নিবেদয়েৎ।
তেনামৃতেন আচমনম্ স্নানীয়মপি কল্পয়েৎ।।
আকাশতত্ত্বম্ বসনম্ গন্ধন্তু গন্ধতত্ত্বকম্।
চিত্তম্ প্রকল্পয়েৎ পুষ্পম্ ধূপম্ প্রাণান্ প্রকল্পয়েৎ।।
তেজস্তত্ত্বান্তু দীপার্থে নৈবেদ্য চ সুধাম্বুধিম্।
অনাহতধ্বনিম্ ঘণ্টাম্ বায়ুতত্ত্বঞ্চ চামরম্।।
নৃত্যমিন্দ্রিয়কর্মাণি চাঞ্চল্যম্ মনস্তথা।।


সাধক নিজের হৃদয়কে পদ্ম রূপে কল্পনা করে সেখানে ইষ্টদেবতার আসন পেতে দেবেন। মস্তিষ্কের সহস্রাতে সহস্রদল পদ্মের যে অমৃত, তা তিনি ইষ্টের পা ধুতে পাদ্য হিসাবে দেবেন। সাধকের মনটি হল অর্ঘ্য। সহস্রার ঐ অমৃতই স্নানজল ও মুখ ধোওয়ার জল রূপে নিবেদন করা হয়, সাধক নিজের ভিতরের আকাশ উপাদানকে বস্ত্র ও ভূমি উপাদানকে গন্ধ রূপে কল্পনা করে নিবেদন করবেন। চিত্তকে পুষ্প কল্পনা করতে হয়। পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান) ধূপ ও অগ্নি তত্ত্ব দীপ রূপে নিবেদিত হয়। সাধকের অনাহত চক্রের অনাহত ধ্বনিই ঘণ্টার প্রতীক। আমাদের অন্তরের সুধা ইষ্টের খাদ্য বা নৈবেদ্য। বায়ু তত্ত্ব হল চামর। সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া বা মনের চাঞ্চল্য নৃত্য রূপে ইষ্টদেবতাকে নিবেদন করতে হয়। 

বাহ্যপূজাক্রমেণৈব ধ্যানযোগেন পূজয়েৎ।
সংপূজ্য চিন্তয়েদ্দেবং বচসা মনসা হৃদা।
তথৈব সাধক্যে লোকে চান্তযোগপরায়ণঃ।। ইতি মুণ্ডমালা তন্ত্রে।

হৃদয়ে প্রার্থনামুদ্রা স্থাপনপুর্ব্বক বাহ্যপূজার উপচার উপকরণাদি এবং উল্লিখিত ক্রমদ্বারা মানসপূজা করিতে হয়।বাক্য মন ও হৃদয় দ্বারা মানস পূজা করিবে।



Sunday, 6 August 2017

ঝুলন যাত্রা

যাত্রা বলতে কি বুঝি? যাত্রার অর্থ হল কোনো লক্ষ্যবস্তুকে বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে নির্ধারিত পথে অভিষ্ট স্থানে পৌঁছে যাওয়া। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, তারমধ্যে বিশেষ কিছু হল রথযাত্রা, রাসযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, ঝুলনযাত্রা ইত্যাদি।
ঝুলনযাত্রা বহুযুগ আগে থেকে ব্রজভূমি বৃন্দাবনে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকা তাঁদের অষ্টসখী ইন্দুরেখা, চিত্রা, চম্পকলতা, ললিতা, বিশাখা, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবী এবং রঙ্গদেবীর সাথে লীলা করেছিলেন ঐ দিনে। ঝুলন হল বর্ষার লীলা যার অপর নাম হিন্দোলনলীলা। ব্রজবাসীরা এই সময় কদমগাছে ঝুলা বেঁধে রাধাকৃষ্ণকে দোল খাওয়ান। একাদশী থেকে শুরু হয় এই ঝুলনযাত্রা আর শেষ  হয় পঞ্চমদিনের পূর্ণিমাতে।   
রাধা কৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা বহিরাঙ্গিকভবে অনেক তাৎপর্যমন্ডিত। এই ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয় শ্রাবণ মাসে। শ্রাবণ মাসের প্রতিপদ তিথি থেকে পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত পাঁচ-দিন এই অনুষ্ঠানটি উদযাপন করা হয়। এই কয়েকদিন রাধা কৃষ্ণের প্রতিমা বা ছবি ঝুলনায়  বসিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঝুলানো হয়। এখানে প্রতীকী হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন-পরা প্রকৃতি বা পুরুষোত্তম আর রাধা হচ্ছেন-অপরা প্রকৃতি ভক্ত স্বরূপিনী। প্রকৃত অর্থে এ  হচ্ছে ভক্ত আর ভগবানের খেলা। পূর্বপশ্চিম দিক দিয়ে ঝুলানোর কারণ হলো সূর্যের উদয় অস্ত নির্দিষ্ট করেই করা হয়, কারণ সূর্য হলো পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস। আর পৃথিবীর গতি ধারা হচ্ছে-দুটো। আহ্নিকগতি ও বার্ষিক গতি। রাধা কৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানটি কবে কোনো সময়ে সর্ব প্রথম আরম্ভ করা হয়েছিল, সেটা জানা নেই,তবে শাস্ত্র ধারণা মতে, এ অনুষ্ঠানটি  খুব সম্ভবত এগারো দশকে দ্বাপর যুগে আরম্ভ হয়েছিল,  গোপালকে দোলনায় তুলে মা যশোদা ঝুলাতেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণের  সঙ্গী সাথীরা গরু চরানোর সময় জঙ্গলের বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝুলানো ঝুলনায় কৃষ্ণকে বসিয়ে খেলা করতেন।  আবার কখনো কৃষ্ণকে নিয়ে গোপ সখা সখিরা সুন্দর সুন্দর ফুল পুষ্পমালা দিয়ে দোলনা সাজিয়ে ঝুলনার আনন্দ উপভোগ করতেন।

শাস্ত্র মতে রাধাহচ্ছেন কৃষ্ণের হলাদিনী শক্তি মহামায়া। রাধা হচ্ছেন কৃষ্ণ ভক্ত শিরোমনি। কৃষ্ণ শক্তিতে, কৃষ্ণপ্রেমে তিনি আরাধিতা ও বলিয়ান তাই তো তিনি রাধা। তাকে বলা হয় জীবজগতের প্রতীকী স্বত্বা, কৃষ্ণ ভক্তের আরাধ্য দেবী। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমভক্তিতে তিনি বলিয়ান তাই রাধা রানীর কৃপা হলে অতি সহজেই কৃষ্ণ কৃপা হয়। আবার রাধা শক্তিতে কৃষ্ণ বলবানতাই তো তারা উভয় মিলে এক ও অভিন্ন। 

Monday, 31 July 2017

শ্রাবণ মাস ও শিব পূজা

              শ্রাবন মাসের নাম এসেছে শ্রবনা নক্ষত্র থেকে, একমাত্র এই মাসেই পুর্ণিমার অস্ত হয় শ্রবণা নক্ষত্রে। এইমাস বিভিন্ন ধর্মকৃত্যের জন্য প্রসিদ্ধ। যে কোন শুভকার্য প্রারম্ভের জন্যে এই মাস শুদ্ধ। এই মাসে প্রতি সোমবার শ্রাবণী সোমবার হিসেবে পালন করা হয়। ফুল-বেলপাতা, গঙ্গাজল,দুধ দিয়ে শিব পূজা করা হয়ে থাকে। অনেকে সূর্য উদয় থেকে সূর্য অস্ত পর্যন্ত উপবাস করে সন্ধ্যের পর শিবপূজা করে থাকেন।
শ্রাবণ মাসে শিব পূজার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে অনেক মত আছে তার মধ্যে কিছু এখানে তুলে ধরার কিছু ক্ষুদ্র প্রয়াস করছি...
পুরাণে বর্ণিত ঘটনাবলীর মধ্যে ‘সমুদ্র-মন্থন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কথিত ‘সমুদ্র মন্থন এই শ্রাবণ মাসেই হয়েছিল। সমুদ্র মন্থনে উত্থিত হলাহল বিষ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে মহাদেব স্বয়ং সেই বিষ কে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে ছিলেন, এবং তার প্রভাবে মহাদেবের কণ্ঠ নীল হয়ে উঠে। সেই জন্যে মহাদেবের আরেক নাম ‘নীলকণ্ঠ’। সেই বিশের প্রভাব এমন ছিল যে স্বর্গের সকল দেবতা শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালতে থাকেন সেই বিষের জ্বালা কমানোর জন্যে। এই দুই ঘঠনাই ঘঠে  ছিল এই শ্রাবণ মাসে। সেই জন্যেই এই শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় গঙ্গা জল প্রদানকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
আবার আরেক মতে সতীর দেহত্যাগের পরে আবার জন্ম নেন দেবী পার্বতী রূপে এবং শিব কে স্বামীরূপে পাবার জন্যে কঠোর সাধনা শুরু করেন। দীর্ঘ সাধনার পরে শিব সন্তুষ্ট হয়ে পার্বতীকে বিবাহ করতে সম্মতি প্রদান করেন এবং কথিত যে এই শ্রাবণ মাসেই শিব-পার্বতীর পুনর্মিলন হয়। সেই জন্যে শ্রাবণ মাস শিব ভক্তদের কাছে অনেক মহত্ব পূর্ণ।
আবার আরেক মতে এই শ্রাবণ মাসেই শিব মর্ত্যে উনার শ্বশুর বাড়িতে আসেন, যেখানে তাকে অত্যন্ত ভক্তি ও ভালবাসার সহিত আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে ও তাঁকে সন্তুষ্টি করার জন্যে অনেক  চেষ্টা করা হয়। তাঁকে পঞ্চামৃত    ( দুধ, দই,ঘি, মধু ও কুশদোক ) দ্বারা অভিষেক করা হয়ে থাকে। যে হেতু শিবের স্বশুর বাড়ি মর্ত্যে এবং এই শ্রাবণ মাসে শিব মর্ত্যে আগমন করেন সেই হেতু এইমাসেই শিব তাঁর ভক্তদের অনেক কাছে চলে আসেন। অল্পে সন্তুষ্ট শিব ঠাকুর তাঁর ভক্তদের সুখ ও সমৃদ্ধি আশীর্বাদ স্বরূপ প্রদান করেন।সেই জন্যে মর্ত্য বাসীদের কাছে শ্রাবণ মাস অনেক গুরুত্ব পূর্ণ।

আবার কারো কারো মতে মহাযোগী শিব এইমাসেই যোগীন্দ্র হয়ে থাকেন, সেইজন্যে শ্রাবণ মাস শিবের ও শিব ভক্তদের অনেক প্রিয় ও মাহত্ম্য পূর্ণ। 


Sunday, 23 October 2016

চৌদ্দ শাক কি এবং কেন?

চৌদ্দ শাক কি এবং কেন?

শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী
(সঙ্কলিত)

আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে চৌদ্দ পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করার জন্যে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে এবং এও বিশ্বাস যে তার ফলে অশুভ শক্তিকে দূরে  রাখা যায় এই দিনটাকে  সাধারণত ভূতচতুর্দশী বলা হয়তবে এর সাথে চৌদ্দ শাকের সম্পর্ক কি তার সঠিক কারণ জানা নাই। অনেকের মতে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এই শাকগুলি খাওয়া হনব্য-স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দনের মতে এই চৌদ্দ শাক হল
১) ওল ২)কেউ ৩)বেতো ৪) কালকাসুন্দে ৫) নিম পাতা ৬) জয়ন্তী ৭) সরিষা 8) শাঞ্চে ৯) হিলঞ্চ ১০) পলতা ১১) শুলফা ১২) গুলঞ্চ ১৩) ঘেঁটু ১৪) শুষনি
(বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকায় উল্লেখ্য)
এবার দেখা যাক এই চৌদ্দ শাকের কি কি ঔষধি গুণ আছে
১) ওল  যা হল  অর্শ, রক্ত আমাশা, বাত, চর্মরোগ, গ্যাস-অম্বল নাশক
২) কেও  যা হল  কৃমিনাশক, হজমকারক, ক্ষুধাবর্ধক
৩) বেতো  যা হল কৃমিনাশক, কোষ্ঠবদ্ধতা ও অম্বল প্রতিরোধক৪) কালকাসুন্দা  যা  অ্যান্টি-অ্যালার্জিক, কোষ্ঠবদ্ধতা, অর্শ, ফিসচুলা, হুপিং কাশি, দাদ ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়
৫) নিম যা  কুষ্ঠ, যে কোন চর্মরোগ, জণ্ডিস, বহুমূত্র, একজিমার ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়
৬) সরিষা যা মানব দেহের চামড়া, যকৃত এবং চোখের পক্ষে এই শাক অত্যন্ত উপকারি
৭)শালিঞ্চা বা শাঞ্চে  সাধারণত ক্ষুধাবর্ধক হিসাবে পরিচিত; এদের ব্যবহারে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়
৮) জয়ন্তী  যা  উদরাময়, বহুমূত্র, শ্বেতী , জ্বর এবং কৃমি নাশকের কাজ করে;
সদ্য প্রসূতিদের জন্য এই শাক উপকারী
৯) গুলঞ্চ  এই শাক সেবনে বাত, রক্তচাপ, একজিমা ও জন্ডিস নির্মূল হয়। তাছাড়া গুলঞ্চ শাক পরিপাকেও সাহায্য করে
১০) পটুক পত্র বা পলতা  এই শাক যে কোন শ্বাসের রোগে কার্যকরী। এরা রক্তবর্ধক এবং লিভার ও চামড়ার রোগ সরাতে এদের প্রভূতভাবে ব্যবহার করা হয়।
১১) ভন্টাকি (ঘেঁটু) বা ভাঁট  ফ্ল্যাভোনয়েড থাকার জন্য এটি ক্যানসার দমনে সহায়ক। এছাড়াও কৃমি, কোলেস্টেরল, ব্লাড সুগার ও উদরাময় প্রভৃতি রোগ নিরাময়ে এই শাক সাহায্য করে।
১২) হিলমোচিকা বা হিঞ্চে  এই শাক ভক্ষণে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে। শুধুমাত্র পিত্তনাশক হিসাবেই নয়, রক্তশোধক হিসাবে, ক্ষুধাবর্ধক এবং জ্বর নির্মূলকারী হিসাবে এর ব্যবহার অপরিসীম
১৩) সুনিষন্নক বা শুষুনী বা শুষনি  শুষনি শাক স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এরা নিদ্রাকারক, মেধা এবং স্মৃতিবর্ধক। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং মানসিক অস্থিরতা কমানোর জন্য এই শাক ব্যবহৃত হয়।
১৪) শেলু বা শুলকা এদের ব্যবহারে হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে। মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়াতে এবং ছোটদের পেটের রোগ সারাতে এই শাক অত্যন্ত উপকারি।
              অন্য মতে চৌদ্দ শাক হল  পালং শাক, লাল শাক, সুষণি শাক, পাট শাক, ধনে শাক, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক, গিমে শাক, মূলো শাক, কলমি শাক, সরষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, লাউ শাক অথবা হিঞ্চে শাক
                  তবে আজকাল বাজারে চৌদ্দ শাকের আঁটি কিনতে পাওয়া যায়। তাতে সচরাচর এসব খুব কমই পাওয়া যায়, তবে নামে চৌদ্দ প্রকারের পাতা পাওয়া যায় এবং  তাই দিয়ে নিয়ম রক্ষার শাক খাওয়া হয়। আবার অনেকে ভাবেন তা নেহাতই বুজরুকি, তাই অনেক ঘরে তার প্রচলন উঠে গেছে। আমার মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষ রা কিছু একটা জেনে এইসবের প্রচলন করেছিলেন কিন্তু যেহেতু আমরা সেই সবের আসল তথ্য জানি না তাই নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে এই সব কে বুজরুকি বা কুসংস্কার বলে চালিয়ে দেই।


Saturday, 22 October 2016

শিবলিঙ্গ-তথ্যের আধারে

শিবলিঙ্গ-তথ্যের আধারে                             
               শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী


নমস্কার,সবাই কে জানাই আমার আন্তরিক শারদ শুভেচ্ছা। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার এই অদম্য সাহসের জন্যে, আমি শাস্ত্র সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, বাংলা ভাষাতেও আমার জ্ঞান খুবই সীমিত তাই ভুলত্রুটি আপনারা নিজগুণে মার্জনা করবেন। আমি এবার শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে অনেকের মধ্যে যে ভুল ধারণা আছে তা দূর করার সামান্য চেষ্টা করছি।
কিছু সংখ্যক অজ্ঞ ও ভ্রান্ত মানুষেরা পরম পবিত্র শিবলিঙ্গ কে জননাঙ্গ ভেবে যা নয় তাই প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই শিবলিঙ্গ’ বলতে পুরুষাঙ্গ বিশেষ মনে করেন-কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। একথা সহজেই অনুমান করা যায় যেনিরাকার পরমাত্মার পুরুষাঙ্গ থাকতে পারে না। তাছাড়া পুরুষাঙ্গের সংস্কৃত প্রতিশব্দ শিশ্ন। আর লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ প্রতীক’ বা চিহ্ন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পাশ্চাত্য গবেষকরা লিঙ্গ ও যোনি কে, নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।ব্রিটিশরা মনে করত,শিবলিঙ্গ পুরুষ যৌনাঙ্গের আদলে তৈরি ও শিবলিঙ্গের পূজা ভক্তদের মধ্যে কামুকতা বৃদ্ধি করে। আমরা সংস্কৃত ভাষা সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ, আমাদের পুরনো তথ্য বিনষ্ট হওয়ার ফলে আজ আমরা প্রকৃত সত্য থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।  সবচাইতে বড় কথা হল আমরা প্রত্যেক সংস্কৃত শব্দের সঠিক রুপান্তর ইংলিশ ভাষায় করতে পারছি না। যার ফলে অনেক সময় মুল বক্তব্য থেকে সঠিক তথ্য অনেক দূরে সরে যায়।লিঙ্গের মুখ্য অর্থ আলয়,  ইন্দ্রিয় বিশেষ কে  লিঙ্গ বলা হয় না।  সর্বভূত যেখানে লয়প্রাপ্ত হয় তাহাই আলয়। যেমন সমুদ্র থেকে সৃষ্ট বুদবুদ জলের উপরে এসে আবার জলেই মিশে যায় ঠিক সেইরূপ এই ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তু অনন্ত শূন্য থেকে জন্ম নিয়ে আবার তাতেই বিলয় হওয়ার জন্যে তাঁকে লিঙ্গ বলা হয়।  লীনং বা গচ্ছতি,লয়ং বা গচ্ছতি ইতি লিঙ্গম্” যা লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গ।আবার কারো মতে সর্ববস্তু যে আধারে লয়প্রাপ্ত হয় তাই লিঙ্গম। এই কারনেই তাকে বিভিন্ন নামে সম্বোধিত করা হয়ে থাকে যেমন প্রকাশ স্তম্ভ/লিঙ্গঅগ্নি স্তম্ভ/লিঙ্গশক্তি স্তম্ভ/লিঙ্গ ইত্যাদি কিন্তু বৈয়াকরণিকগণের মতে লিঙ্গতে চিহ্নতে মনেনেতি লিঙ্গম্”| লিঙ্গ শব্দের অর্থ প্রতীক’ বা চিহ্ন’| যার দ্বারা বস্তু চিহ্নিত হয়সত্য পরিচয় ঘটে তাই-ই লিঙ্গ। অর্থাৎ যার দ্বারা সত্যবিজ্ঞান লাভ হয়যার সাহায্যে বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায় তাকেই বস্তু পরিচয়ের চিহ্ন বা লিঙ্গ বলে। আর এজন্যই দেহ প্রকৃতিতে লীনভাবে অবস্থান করে বলেই চিদ্ জ্যোতিকে বলা হয় লিঙ্গ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে লিঙ্গ একটি সংস্কৃত শব্দ যা শুন্য,আকাশঅনন্ত ব্রহ্মাণ্ড ও নিরাকার পুরুষের প্রতীক। উপনিষদে সুক্ষ্ম দেহের বর্ণনায় বলা হয়েছে ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ’ শিব আমাদের হৃদয় মধ্যে অঙ্গুষ্ঠ পরিমান স্থানে আছেন, শিবপুরাণ ও অন্যান্য সকল শাস্ত্রেই শিবলিঙ্গ’ বলতে পরমব্রহ্মের প্রতীক’-ই বোঝানো হয়েছে। স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে  ‘আকাশং লিঙ্গমিত্যাহুঃ পৃথিবী তস্য পীঠিকা। প্রলয়ে সর্বদেবানাং লয়নাল্লিলিঙ্গমুচ্যতে।।’আকাশ স্বয়ং লিঙ্গধরণী তাঁর পীঠ বা আধার। প্রলয়কালে দেবতা সকল লয় প্রাপ্ত হলে একমাত্র লিঙ্গ রূপী শিবই বর্তমান ছিলেন। সেইকারণে লিঙ্গ শব্দে একমাত্র মহাদেবকেই বোঝায়। একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ীশিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।হিন্দুরা শিবলিঙ্গকে সৃষ্টির পিছনে নারী ও পুরুষ উভয়ের যে অবদান তার কথা স্মরণ করে  শিবলিঙ্গের পূজা করেন শিবলিঙ্গে যে যোনি চিহ্ন দেখা যায়  তাকে গৌরীপট্ট বা গৌরী পীঠ বলে।এই গৌরীপট্ট বা গৌরী পীঠ হল মহাশক্তির প্রতীক। শিবলিঙ্গ ও যোনি র এই সম্মিলিত রূপটিকে "নারী ও পুরুষের অবিচ্ছেদ্য ঐক্যসত্ত্বা এবং জীবনসৃষ্টির উৎস পরোক্ষ স্থান ও প্রত্যক্ষ কালের প্রতীক" হিসেবে গণ্য করা হয়।পুরো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যে অক্ষের উপর ঘুরচ্ছে সেটাই লিঙ্গ... শিব লিঙ্গ। আক্ষরিক বিশ্লেষণে দেখা যায়- শিব’ শব্দের অর্থ মঙ্গল’ আর লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। শাস্ত্র শিব’ বলতে নিরাকার সর্বব্যাপি পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মকেই বোঝায়। তাই শিবলিঙ্গ’ হচ্ছে মঙ্গলময় পরমাত্মার প্রতীক। শিবপুরাণ অনুসারে ভগবান শিবই একমাত্র ব্রহ্মরূপ হওয়ায় তাঁকে নিরাকার বলা হয়। যেহেতু তিনি সর্বশক্তিমান’ তাই তিনি জগতকল্যাণের জন্য রূপধারণও করতে পারেন। রূপবান হওয়ায় তাঁকে সাকার বলা হয়। তাই তিনি সাকার ও নিরাকার-দুইই। শিব সাকার ও নিরাকার হওয়ায় তাঁর পূজার আধারভূত লিঙ্গও নিরাকার অর্থাৎ শিবলিঙ্গ  শিবের নিরাকার স্বরূপের প্রতীক। তেমনই শিব সাকার হওয়ায় তাঁর পূজার আধারভূত বিগ্রহ সাকাররূপ। শিব ব্যতীত অন্য যেসকল দেবতা আছেনতাঁরা সাক্ষাৎ ব্রহ্ম ননতাই কোথাও তাঁদের নিরাকার লিঙ্গ দেখা যায় না। লিঙ্গ সাক্ষাৎ ব্রহ্মের প্রতীক। স্বামী বিবেকানন্দ প্যরিসে হয়ে যাওয়া ধর্মসমূহের ঐতিহাসিক মূল শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্ববাসীর সামনে অথর্ববেদের স্কম্ভসুক্তের সাহায্যে তুলে ধরেন যে শিবলিঙ্গ মূলত বিশ্বব্রহ্মান্ডেরই প্রতীক। আমরা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনায় পাই যে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে শিবলিঙ্গ ধারণাটি এসেছে বৈদিক যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ ধারণা থেকে। যূপস্তম্ভ বা স্কম্ভ হল বলিদানের হাঁড়িকাঠ।এটিকে অনন্ত ব্রহ্মের একটি প্রতীক মনে করা হত। জার্মান প্রাচ্যতত্ত্ববিদ গুস্তাভ ওপার্ট শালগ্রাম শিলা ও শিবলিঙ্গের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে এগুলিকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গে সৃষ্ট প্রতীক বলে উল্লেখ করে তা পাঠ করলেতারই প্রতিক্রিয়ায় বিবেকানন্দ এই কথা বলেছিলেন।বিবেকানন্দ বলেছিলেনশালগ্রাম শিলাকে পুরুষাঙ্গের অনুষঙ্গ বলাটা এক কাল্পনিক আবিষ্কার মাত্র। শিবলিঙ্গর সঙ্গে পুরুষাঙ্গের যোগ বৌদ্ধধর্মের পতনের পর আগত ভারতের অন্ধকার যুগে কিছু অশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত গল্প। স্বামী শিবানন্দ সরস্বতী ও বলেন, "এটি শুধু ভুলই নয়বরং অন্ধ অভিযোগও বটে যে শিবলিঙ্গ পুরুষলিঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী"। এমনি আরও অনেক জ্ঞানী,গুণী,সাধু-সন্ত ও মহাপুরুষেরা শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা নির্মূলের স্বপক্ষে অনেক মাতবাদ প্রকাশ করেছেন, স্বল্প পরিসরে তার বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলা যেতে পারে যে আমাদের নিজেদের অজ্ঞতাকে আড়াল করতে গিয়ে ও ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে এমন কোন আচরণ বা মন্তব্য করা উচিত নয় যা সমাজে সকল শ্রেণী, সকল জাতির কাছে আমাদের এই মহান ধর্ম এক হাস্যকর বিষয় হয়ে উঠে। আমাদের সকলের কর্তব্য কোন বিষয়ে মন্তব্য করার আগে সেই বিষয় টিকে সঠিক ভাবে জেনে নেওয়া আর আমরা যতটুকু সঠিক জানি তা সকলের মধ্যে বিলিয়ে  দেওয়া যাতে অন্যরাও তাঁদের ভ্রান্ত ধারণা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে ও মিথ্যে সমালোচক দের যোগ্য জবাব দিতে পারে। সবচাইতে গুরুত্ব পূর্ণ হল বর্তমান প্রজন্মের কাছে এইসকল তথ্য তুলে ধরা যাতে তারাও কোন ভুল ধারনার শিকার হয়ে নিজ ধর্মকে অবহেলা করতে শুরু না করে, বরঞ্চ গর্বের সাথে নিজ ধর্মের মহানতা সকলের কাছে  প্রকাশ করতে পারে। বিভিন্ন সূত্রের সাহায্যে এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করা ও সকলের কাছে তা প্রকাশ করার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস তখনই সার্থক মনে হবে যখন সমাজ থেকে এই বিষয় সম্বন্ধে ভুল ধারণার অবসান ঘটবে।
জগন্মাতা দেবী দুর্গার কাছে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সদবুদ্ধির প্রার্থনা জানাই।
                                      জয় শিব-শম্ভু... জয় মা দুর্গা। 

সুত্রঃ শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, স্বামীজীর বাণী ও রচনা, তন্ত্র রশ্মি ১ম খণ্ড, "Worship of Siva Linga" by Swami Sivananda Saraswati ইত্যাদি

পিতৃ তর্পণ

পিতৃ তর্পণ
শ্রী দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী

বর্তমানে বিভিন্ন পরিস্থিতির চাপে ও বিভিন্ন কারনে  আমাদের অনেককিছু আচার-অনুষ্ঠান প্রায় লুপ্ত ।পিতৃ তর্পণ ও তেমনই একটি, বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে আজ তার অর্থ অজানা। অনেকে হয়তো বা আবেগের বশে পিতৃ তর্পণ করে থাকেন কিন্তু কি করছেন বা কিসের জন্যে করছেন তা রয়ে যাচ্ছে অজানা। দুর্গা পূজার আগে পিতৃ পক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এই তর্পণ অনুষ্ঠান, আসুন জেনে নেই তার কিছু তথ্য।শাস্ত্র বিষয়ে আমি নিতান্ত অজ্ঞ বাংলা ভাশাতেও আমার জ্ঞান সীমিত, তাই ভুল ত্রুটি  নিজগুণে মার্জনা করবেন।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে এই পিতৃ পক্ষ কি?
   ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার পরের তিথি অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে পরের অমাবস্যা বা মহালয়ার দিন পর্যন্ত দিন গুলিকে পিতৃপক্ষ বলে জানা যায় এবং এই  পিতৃপক্ষে স্বর্গত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পার্বন  শ্রাদ্ধ ও তর্পন করা হয়। কথিত আছে যে এই সময় যমালয় থেকে মর্ত্যলোকে পিতৃ পুরুষেরা আসেন তাঁদের বংশধরের কাছে এবং তাদেরকে তৃপ্ত করার জন্য তিল,জল দান করা হয়। তাহাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্যে উল্কাদান ও করা হয়।  আমরা মহাভারতে পাই যে, মহাবীর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাঁকে খেতে দেওয়া হয় শুধু সোনা আর ধনরত্ন। তার  কারণ কর্ণ ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বললেন যে  যেহেতু তিনি  সারাজীবন শুধু সোনাদানাই দান করেছেন এবং পিতৃপুরুষকে জল  দান করার কথা ভুলেই গেছিলেন, তাই তার এই অবস্থা। উত্তরে কর্ণ বলেন যে  তাঁর  পিতৃপুরুষের পরিচয় তিনি যুদ্ধ শুরুর  আগের রাতেই জানতে পেরেছিলেন, যখন তাঁর মা কুন্তী  এসে  তাঁর জন্ম কাহিনিও পরিচয় দেন পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয় সেই হেতু পিতৃতর্পণ তিনি করতে পারেন  নাই ইন্দ্র বুঝলেন যে এতে কর্ণের কোন দোষ নেই। তিনি কর্ণকে পনেরো দিনের জন্য মর্ত্যে ফিরে গিয়ে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিতে অনুমতি দেন  ইন্দ্রের কথা মতো এক পক্ষকাল ধরে কর্ণ মর্ত্যে অবস্থান করে পিতৃপুরুষকে অন্নজল প্রদান করে নিজের পাপ দূর করেন। সেই পক্ষটি পরিচিত হল পিতৃপক্ষ নামে। এই পিতৃ তর্পণের পরিচয় মার্কণ্ডেয় পুরাণে ও পাওয়া যায় সেখানে বলা হয়েছে যে পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন। পিতৃতর্পণে আমরা যাদের উদ্দেশ্যে  জল দান করে থাকি তা কিছুটা এই রকম... তর্পণের শুরুতে করা হয় দেব তর্পণ এই মন্ত্রে ‘ওঁ ব্রহ্মা তৃপ্যতাম্।। ওঁ বিষ্ণুস্তৃপ্যতাম্।ওঁ রুদ্রস্তৃপ্যতাম্।। ওঁ প্রজাপতিস্তৃপ্যতাম্। এই চার জন ছাড়া মন্ত্র ও জল দ্বারা দেব, যক্ষ, নাগ, গন্ধবর্ব, অপ্সরা, অসুর, ক্রুরস্বভাব জন্তু, সর্প, সুপর্ণ যা হল গরুড়জাতীয় পক্ষী ও  বৃক্ষ, সরীসৃপ, সাধারন পক্ষী, বিদ্যাধর কিন্নর, জলচর, খেচর, ভূত  এবং পাপে ও ধর্মকার্য্যেরত যত জীব আছে, তাহাদের তৃপ্তির জন্য তর্পণ করা হয় দেব তর্পণের পর করা হয় মনুষ্য তর্পণ মন্ত্রের অর্থ কিছুটা এই সনক, সনন্দ, সনাতন, কপিল,আসুরি, বোঢ়ু ও পঞ্চশিখ আপনারা সকলে আমার প্রদত্ত জলে সর্বদা তৃপ্তিলাভ করুন, এবং মন্ত্র ও জল দ্বারা আমরা মরীচি, অত্রি,অঙ্গিরা,পুলস্ত,পুলহ, ক্রতু,প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ প্রভৃতি ঋষি গনের তর্পণ করি।দিব্য-পিতৃ-তর্পণে আমরা সাতটি মন্ত্র দ্বারা প্রত্যেককে এক এক অঞ্জলি সতিল জল দিব্য পিতৃ গনের উদ্দেশ্যে দান করে থাকিতারপর, হে আমার পূর্ব্বপুরুযগণ  আসুন, এই অঞ্জলি পরিমিত জল গ্রহণ করুন বাক্যে আবাহন করা হয় পিতৃ পুরুষ গন কে ও ভক্তিসহকারে স্বর্গত পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতামহ, প্রমাতামহ, বৃদ্ধপ্রমাতামহ, মাতা, পিতামহী, প্রপিতামহী, মাতামহী, প্রমাতামহী, বৃদ্ধপ্রমাতামহী, গুরু, জ্যেঠা, খুড়া, বিমাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী, জ্যেঠী, খুড়ী, পিসি,মাসী, মাতুল, মাতুলানী, শ্বশুর, শাশুড়ী, ভগ্নিপতি, জ্ঞাতি, আদি যতজন যে সকল দেহত্যাগ করেছেন তাঁদের সকলের  নামে তর্পণ করা হয়।তর্পণের সবচাইতে সুন্দর যে অংশটি যা আমাকে অতিশয় অভিভূত করে সে হল আমার বংশে যে সকল জীব অগ্নিদ্বারা দগ্ধ হইয়াছেন, অর্থাৎ যাঁহাদের দাহাদি সংস্কার হইয়াছে  বা  যাঁহারা দগ্ধ হন নাই  অর্থাৎ কেহই তাঁহাদের দাহাদি-সংস্কার কার্য্য করেন নাই  তাঁদের তৃপ্তি ও স্বর্গ লাভের জন্যে ওঁ নমঃ অগ্নিদদগ্ধাশ্চ যে জীবা... এই মন্ত্র সহকারে জল দান করা ও  ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা...মন্ত্রে আমাদের যে সকল আমাদের বন্ধু ছিলেন এবং যে সকল আমার বন্ধু নন, যে সকল জন্ম-জন্মান্তরে আমাদিগের বন্ধু ছিলেন, এবং যারা আমাদের নিকট হইতে জলের প্রতাশা করেন, তাঁদের সম্পূর্ণরূপে তৃপ্তি লাভের জন্যে ও তর্পণ করা হয়। এরপর আমরা করি ভীষ্ম-তর্পণ, এই মন্ত্রের অর্থ কিছুটা এই যে    বৈয়াঘ্রপদ্য যাঁহার গোত্র,সাঙ্কৃতি যাঁহার প্রবর, সেই অপুত্রক ভীষ্মবর্ম্মাকে এই জল দিতেছি।শান্তনু-তনয় বীর, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয় ভীষ্মবর্ম্মা এই জল দ্বারা পুত্র-পৌত্রচিত তর্পণাদি-ক্রিয়া-জনিত তৃপ্তি লাভ করুন। ভীষ্ম- তর্পণের পর করা হয় রাম-তর্পণ, সম্পূর্ণ তর্পণ করা সম্ভব না হলে  শুধু এই তর্পণ  করলেই হয় বলে বিশ্বাসশ্রীরামচন্দ্র বনবাস কালে এই মন্ত্রেই তর্পণ করেছিলেন বলে বর্ণিত আছে
মন্ত্রটি হল, মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে ব্রহ্মলোক অবধি যাবতীয় লোক সমীপে অবস্থিত জীবগণ,যথা যক্ষ, নাগাদি, দেবগণ, যথা ব্রহ্মা , বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি, ঋষিগণ যথা মরীঢি, অত্রি, অঙ্গিরাদি, পিতৃগণ,মনুষ্যগণ সনক, সনন্দ প্রভৃতি, পিতৃ-পিতামহাদি এবং মাতামহাদি সকলে তৃপ্ত হউন ।আমার কেবল এই জন্মের নয়, আমার বহুকোটিকুল, বহু জন্মান্তরে গত হইয়াছেন, সেই সকল কুলের পিতৃ-পিতামহাদি, সপ্তদ্বীপবাসী যথা জম্বু, প্লক্ষ, শাল্মলি, কুশ, ক্রৌঞ্চ, শাক, পুষ্কর, সমুদয় মানবগণের পিতৃ-পিতামহাদি এবং ত্রিভুবনের যাবতীয় পদার্থ আমার প্রদত্ত জলে তৃপ্ত হউনতারপরে করা হয় লক্ষণ-তর্পণ, এও বিশ্বাস যে রাম-তর্পণেও অশক্ত হইলে এই তর্পণ করা হয়, কারণ বনবাসকালে রাম ও সীতার সেবায় ব্যাস্ত থাকার সময় সময়াভাবে, লক্ষণ শুধু যে মন্ত্রে তর্পণ করতেন তার অর্থ হল—‘ব্রহ্মা হইতে তৃণ পর্ষ্যন্ত জগৎ,জগতের লোক, স্থাবর জঙ্গমাদি, সকলে তৃপ্ত হউনতারপর বস্ত্র নিংড়ানো জলে যাঁহাদের কেহ কোথাও নাই তাঁহাদের তর্পণ করা হয় মন্ত্রে বাংলায় যার অর্থ এই দাঁড়ায় —‘যাঁহারা আমাদের বংশে জন্মিয়া পুত্রহীন ও বংশহীন হইয়া গত হইয়াছেন, তাঁহারা আমার এই  বস্ত্র-নিংড়ানো জলে তৃপ্ত হউনএরপর ওঁ নমঃ পিতা-স্বর্গঃ পিতা-ধর্ম্মঃ...মন্ত্রে করা হয় পিতৃস্তুতি
যার অর্থ... পিতাই স্বর্গ, পিতাই ধর্ম্ম, পিতাই পরম তপস্যা অর্থাৎ পিতা সেবাই তপস্যা, পিতা প্রসন্ন হইলে সকল দেবতাই প্রীত হন ও পিতৃপ্রণাম করা হয় যে মন্ত্রে তার অর্থ এই যে যাঁহারা স্বর্গে মূর্ত্তি ধারণ করিয়া বিরাজ করিতেছেন, যাঁহারা শ্রাদ্ধান্ন ভোজন করেন, অভীষ্ট-ফলের কামনা করিলে যাঁহারা সকল বাঞ্ছিত-ফল দান করিতে সমর্থ এবং কোন ফলের কামনা না করিলে যাঁহারা মুক্তি প্রদান করেন , সেই পিতৃগণকে প্রণাম করিসূর্য্যদেবের উদ্দেশে  পূর্ব্বদিকে মুখ করে ওঁ নমো বিবস্বতে ব্রহ্মণ, ভাস্বতে... মন্ত্রে জল দেয়া হয় তারপর  অর্থাৎ  হে পরম ব্রহ্মস্বরূপ সবিত্রিদেব ! আপনি তেজস্বী, দীপ্তিমান ; বিশ্বব্যাপী তেজের আধার, জগতের কর্ত্তা, পবিত্র, কর্ম্মপ্রবর্ত্তক; আপনাকে প্রণাম করি। ওঁ নমঃ জবাকুসুম-সংঙ্কাশং, কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং... মন্ত্রে প্রণাম জানাই সূর্য্যকে যার অর্থজবাফুলের ন্যায় রক্তবর্ণ, কশ্যপের পুত্র, অতিশয় দীপ্তশালী, তমোনাশী, সর্ব্বপাপ নাশকারী দিবাকরকে প্রণাম করি।সর্বশেষে অচ্ছিদ্রাবধারণ,বৈগুণ্য-সমাধান ও জপের দ্বারা আমরা তর্পণের সমাপ্তি করে থাকি
পরিশেষে এতটুকুই বলা যায় যে তর্পণ, পূর্বপুরুষ দের সাথে পরবর্তী প্রজম্মের এক পরিচয় পর্ব অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা যেতে পারেযার মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ দের স্মরণ করতে পারি, যাদের করুণায় আমাদের এই মানবদেহ অর্জন, তাঁদের প্রতি আমরা এই সামান্য জল ও তিলের দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রদান করে থাকি। এই তিল-জল দানে তাঁদের কতটুকু তৃপ্তি লাভ হয় সেটা হয়তো অনেকের কাছে তর্কের বিষয়, কিন্তু আমাদের মনের কোনে হয়তো বা এই আচার কিছুটা তৃপ্তি বোধ আনে বা এনে দিতে পারেআজকালের এই লুপ্তপ্রায় আচার-অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে এই পিতৃ পক্ষে কিছু সংখ্যক মানুষের তর্পণের আগ্রহ দেখে মনে হয় যে আমাদের কাছে আমদেরই পূর্বজের অনুষ্ঠিত কিছু আচার অনুষ্ঠান এখনও সমাদৃত আছে। তবে তা কতদিন থাকবে সেটাই বিচার্য। তর্ক-যুক্তির প্রভাবে এই  অনুষ্ঠান ও কোনদিন হারিয়ে যাবে আমাদের সমাজ থেকে।
       মা ভগবতী সবার মঙ্গল করুন। সবাই সুখে থাকুন... জয় মা।


তথ্যসুত্রঃ তর্পণ বিধি- শ্রীযুক্ত শশধর ভট্টাচার্য। 

কৌশিকী অমাবস্যা

  ছবি  কৃতজ্ঞতাঃ- গুগল চিত্র পুরাণমতে, কৌশিকী অমাবস্যার শুভতিথিতে পরাক্রমশালী শুভ-নিশুম্ভ অসুর দুই ভাইকে বধ করার সময়েই দেবী পার্বতীর দেহের ...